গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে প্রায় টানা পতনের ধারায় রয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। দরপতনের কারণে হাজার হাজার টাকা হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এর মধ্যে নানা পদক্ষেপ নিলেও বাজারে আস্থা ফেরেনি। অবশেষে নয় মাস পর হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত রোববার তিনি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। সেখানে বাজারে আস্থা ফেরানোর উপর জোর দেন; বাজার চাঙা করতে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন তিনি।
তাঁর এই সভা ও নির্দেশনা পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থা ফেরার কথা। তার একটা ইতিবাচক প্রভাব গতকাল সোমবার শেয়ারবাজারে পড়বে বলে ধারণা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু আশানুরূপ ফল দেখা যায়নি। পুঁজিবাজারের পরিসংখ্যানই বলে দেয়, এই বৈঠক ও নির্দেশনা বিনিয়োগকারীরা ততটা আস্থায় নিতে পারেনি।
গতকাল বাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। দেশের দুটি স্টক এক্সচেঞ্জেই নামমাত্র সূচক বাড়লেও লেনদেন ছিল তলানিতে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ১৯ পয়েন্ট সূচক বাড়লেও লেনদেন তিনশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে চারশ কোটির ঘরও ছুঁতে পারেনি। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকও একই সমান বেড়েছে। তবে লেনদেন হয়েছে কেবল ৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক নিয়ে ব্যাপক প্রত্যাশা থাকলেও দিন শেষে হতাশ হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। যে ৫টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি গত এক দশক ধরে শুনে আসছেন সবাই। তবে কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। কেবল ‘বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে পুঁজিবাজার সংস্কারের’ বিষয়টি নতুন হলেও তা ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’ বলে মনে করেন অংশীজনেরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি মনে করি, বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ আনার দরকার নেই। বাকি যেগুলো উনি বলেছেন, সেগুলো আমি বিভিন্ন সময় বলে এসেছে। সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির মধ্যে করপোরেট করহারের ব্যবধান বাড়ানো যেতে পারে। বাইরে থেকে এক্সপার্ট এনে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, উনারা মিটিংগুলো কেন করেন? বুঝি না। মিটিং করে কিছুই যদি দেওয়ার না থাকে (বিনিয়োগকারীদের), তাহলে ফলস হোপ দেওয়ার জন্য আসার তো কোনো কারণ দেখি না।’
বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে পুঁজিবাজার সংস্কার উদ্যোগের সমালোচনা করে অধ্যাপক মুসা বলেন, ‘সংস্কার শব্দটা এমন হয়ে গেছে, যেন সব রোগের দাওয়ায়। কিন্তু সংস্কারটা কী হবে, কখন হবে, সেটাই বেসিক্যালি আমরা বুঝি না।’
এই বৈঠক থেকে আশাবাদী হওয়ার কিছু পাননি শেয়ার লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান বিআরবি সিকিউরিটিজের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলমগীর হোসেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতির মানুষ, উনারা বাজার ভালো করার উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু, বাজার খারাপ হতে হতে মানুষ শেষ।’
একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের সিইও বলেন, ‘মাকসুদ সাহেব উনাকে কী বললেন, ‘সেটা শুনে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এগুলো (৫ নির্দেশনা) বললেন। বিদেশি কাকে নিয়োগ করবে? এটা সেই মার্কেট নাকি? আমার ডায়রিয়া হয়েছে, স্যালাইন না দিয়ে নাপা দিলে হবে? হবে না।’
ধারাবাহিক দরপতনে হাজার হাজার কোটি টাকা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা। দিশেহারা হয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নামছেন তাঁরা।
এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এবং পুঁজি সুরক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন বিএসইসির বর্তমান কমিশনকে। বরং এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার আয়োজনে বিএসইসির অধস্তন কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত প্রশিক্ষণে বিএসইসি চেয়ারম্যানের অংশগ্রহণ, সংবাদমাধ্যমে এক কমিশনারের শেয়ারব্যবসার তথ্যফাঁস বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে গত রোববার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকা হয়। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব নাজমা মোবারেক প্রমুখ।
সেখানে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি প্রধান উপদেষ্টাকে ব্রিফ করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। এর পরিপ্রক্ষিতে ৫টি নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। এর মধ্যে রয়েছে- সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা, দেশি-বিদেশি বড় কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে পুঁজির যোগান এবং বিদেশি বিশেষজ্ঞ (ফরেন এক্সপার্ট) এনে ৩ মাসে পুঁজিবাজার সংস্কার করার কথা বলা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের হওয়া সিদ্ধান্তকে হাস্যকর উল্লেখ করে একটি ব্রোকারেজ হাউজের সিইও বলেন, ‘পুঁজিবাজারে সংস্কার করেন, সমস্যা নেই। সংস্কারের নামে দিনে দিনে বিনিয়োগকারীদের শেষ করে দিচ্ছেন। ফাইন করে যাচ্ছেন, কিন্তু এসব টাকা কি আদায় করতে পেরেছেন? এ সমস্ত কাজ পরেও করা যাবে।’