আমাদের জৈবিক ঘড়ি বা বায়োলজিক্যাল ক্লক আমাদের শরীরের ঘুম, তাপমাত্রা, হরমোন নিঃসরণ, স্মৃতিশক্তি, ভালো লাগা, মন্দ লাগা সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই জৈবিক ঘড়ির নিয়মমাফিক আবর্তনের ফলেই আমাদের ঘুম সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়; কিন্তু সঠিক ঘুমের অভাবে আমাদের অনেক বিপত্তি ঘটে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মানসিক রোগ, হার্টের নানারকম রোগ এগুলো মোটাদাগে ঘুমের সমস্যা ও নাক ডাকার ফসল। এমনকি সঠিক ঘুমের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা, অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদেরও কারণ হতে পারে। কাজেই আমাদের পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন।
বয়স অনুযায়ী ঘুমের প্রয়োজনীয় সময়: যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের পরামর্শ অনুযায়ী ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের রাতে অন্তত ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের রাতে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য ঘুমানো প্রয়োজন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। অনেকে এর চেয়ে কম ঘুমিয়েও সুস্থ থাকতে পারেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজি ও নিউরো সায়েন্সের অধ্যাপক ম্যাথিউ ওয়াকার ‘হোয়াই উই স্লিপ’ বইয়ে লিখেছেন, ঘুম কম হলে দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা।
কম ঘুমে কী সমস্যা: ম্যাথিউ ওয়াকারের মতে, ঘুম কম হলে নতুন স্মৃতি তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ঘুম কম হলে মস্তিষ্কে ‘বিটা অ্যামিলয়েড’ নামের ক্ষতিকর প্রোটিন তৈরি হয়। অ্যালঝেইমার রোগের সঙ্গে এই প্রোটিনটির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের শরীর মস্তিষ্ক থেকে বিটা অ্যামিলয়েড ও এরকম অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করে। কাজেই ঘুম কম হলে অ্যালঝেইমার রোগ সৃষ্টিকারী এই প্রোটিন ও এরকম ক্ষতিকর পদার্থগুলো মস্তিষ্কে জমবে। যত দিন যাবে, ডিমেনশিয়া তৈরি হবে। এ ছাড়া ঘুম কম হওয়ায় প্রজননতন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। যেসব পুরুষ রাতে মাত্র পাঁচ বা ছয় ঘণ্টা ঘুমান, তাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায়, এটা তাদের শারীরিক বয়সকে প্রকৃত বয়সের চেয়ে ১০ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
কম ঘুমের প্রভাব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপরও পড়ে। মাত্র এক রাত চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমালে শরীরের ক্যান্সার প্রতিরোধী কোষগুলোর ৭০ শতাংশ মরে যায়। কম ঘুম অন্ত্রের ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের মতো রোগের আশঙ্কা তৈরি করে। ঘুমের স্বল্পতা প্রাণঘাতী স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা ২০০ গুণ বাড়িয়ে দেয়।
ঘুম হলো দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ঘুমের সময় সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত থাকে। ঘুম শরীরকে চাঙা করে পরবর্তী দিনের কাজের জন্য আমাদের তৈরি করে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিকঠাক রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই।
ডা. মনিলাল আইচ লিটু
অধ্যাপক, ইএনটি অ্যান্ড হেড-নেক সার্জারি
সাধারণ সম্পাদক, অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপোনিয়া বাংলাদেশ