Homeঅর্থনীতিঅর্থনৈতিক উত্তরণের এক অনাড়ম্বর বাজেটে যা থাকছে

অর্থনৈতিক উত্তরণের এক অনাড়ম্বর বাজেটে যা থাকছে


সাধারণত বাজেট মানেই ব্যাপক উৎসব, প্রবৃদ্ধির উচ্ছ্বাস আর মেগা প্রকল্পের মোহ। কিন্তু এ বছর দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট প্রস্তাবনা একেবারে ভিন্ন মাত্রার। আজ সোমবার (২ জুন) বিকাল ৩টায় প্রথমবারের মতো বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড.সালেহউদ্দিন আহমেদ। আর এটি হতে যাচ্ছে ‘বাস্তবতা নির্ভর’ এক অনাড়ম্বর বাজেট, যেখানে রঙচঙে প্রতিশ্রুতির বদলে থাকবে কঠিন বাস্তবতার স্বর।

৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে অর্থ উপদেষ্টা স্পষ্ট বার্তা দিতে চাইছেন– ‘বেল্ট টাইটেনিং’ শুরু হয়েছে। আগের তুলনায় বাজেটের পরিমাণ কমেছে ৭ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।

অগ্রাধিকার পাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান

বাজেটে মেগা প্রকল্প কিংবা উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নেই। সরকার এবার সামাজিক খাতে– বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে জোর দিতে চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘জিরো বেকারত্ব’ ভিশনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি দেশের জন্য বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই শিক্ষা নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু চাকরি নেই। আবার বিপুলসংখ্যক শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন, যাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। বাজেটে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।’

সাবসিডি থাকবে কৃষি ও খাদ্যে, কমবে কর ছাড়

বাজেটে খাদ্য ও কৃষি উপকরণে সাবসিডি অব্যাহত রাখা হলেও অন্য খাতে কর ছাড়ের সংস্কৃতি বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি এর আগে এক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট বলেন, ‘আমি প্রতিটি কর ছাড় বাতিল করতে চাই।’ অর্থাৎ বাজেটে ‘নির্বাচিত উদারতা’র যুগের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

চাপে থেকেও টিকে আছে অর্থনীতি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ; যা মহামারিকাল পরবর্তী সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। কৃষি খাতে ধীরগতির কারণেই এই পতন ঘটেছে। তবে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। বাজেটের সামগ্রিক কাঠামোতে ব্যয় সংকোচনের প্রবণতা স্পষ্ট। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের আকার কিছুটা কমানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কমিয়ে আনা হচ্ছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার যেখানে ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, সেখানে আগামী অর্থবছরে তা নামিয়ে আনা হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়। বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে জিডিপির ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও বরাদ্দ কাটছাঁট করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ধরা হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় কম। পাশাপাশি কিছু প্রকল্প বা উপকারভোগীকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতার বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, সুদের বোঝা বাড়ছে। সরকারকে আগামী অর্থবছরে শুধু সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হবে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৯৭ হাজার কোটি টাকার মতো।

এবার রাজস্ব বাজেটের আকার কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।

যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বারবার ভর্তুকি কমানোর ওপর জোর দিয়ে আসছে, তারপরও সরকার বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ হতে পারে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাজেটটি বাস্তববাদী কাঠামোয় সাজানো হলেও, তা বাস্তবায়নে সক্ষমতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার, কিন্তু ভ্যাট বাড়ছে

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বাজেটের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরলেও, সাধারণ করদাতাদের জন্য আয়করে কোনও বাড়তি ছাড় রাখা হয়নি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে। বরং বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হচ্ছে। ফলে বাজেটের এই পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতির ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ-পরবর্তী বাস্তবতায় প্রস্তুত হতে বেশ কয়েকটি আমদানিকারক খাতে শুল্ক হ্রাসের প্রয়োজন পড়ছে। এসব ছাড়ের কারণে রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ভ্যাট এবং আয়কর খাতে।

তবে আয়কর খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখনও চ্যালেঞ্জিং। কর-জিডিপি অনুপাত এখনও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে রাজস্ব আহরণে ‘সহজ টার্গেট’ হিসেবে মূল্য সংযোজন করের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে; যা ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সরকারি ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে মুদ্রানীতিও সংকোচনমূলক থাকবে। বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে সহনীয় কর কাঠামো বজায় রাখা হবে, যাতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ওপর চাপ না পড়ে।

তিনি আরও জানান, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ও কার্যকর রাখার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকবে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে ভ্যাট বাড়ানো, অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি– এই দ্বিমুখী চাপ খুচরা বাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন সফল না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হতে পারে।

যেসব নীতিগত পরিবর্তন আসছে নতুন বাজেটে

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। সরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক, করদাতা ও ব্যবসায়ী– সব শ্রেণির মানুষের ওপর এসব পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে।

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা

আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রথম থেকে নবম গ্রেডভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা আসতে পারে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাড়ছে ভাতা

চলমান আটটি ভাতা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতার পরিমাণ ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমে নতুন সংযোজন হিসেবে তাদের সন্তানদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সম্প্রসারণ

বর্তমানে প্রতি বছর পাঁচ মাস ধরে ৫০ লাখ পরিবারকে কম দামে চাল বিক্রি করা হয় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায়। আগামী বাজেটে এ কর্মসূচি বাড়িয়ে ছয় মাস করা হচ্ছে এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ৫৫ লাখে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

শহীদ ও আহতদের পরিবারে নতুন সহায়তা

জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য এককালীন আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মাসিক ভাতা চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

সরকারি মালিকানায় নেওয়া হচ্ছে কিছু ব্যাংক

বেসরকারি খাতের কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।

করপোরেট করের হার বাড়ছে

তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হতে পারে। একইসঙ্গে, বার্ষিক তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য ন্যূনতম করহার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে।

জমি-ফ্ল্যাট লেনদেনে করহারের পরিবর্তন

জমি কেনাবেচার ওপর করহার এলাকাভেদে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে, যা বর্তমানে ৮, ৬ ও ৪ শতাংশ। তবে জমি ও ফ্ল্যাট কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বজায় থাকছে। তবে করহার এলাকাভেদে বর্তমানে যা আছে, তা কয়েক গুণ বাড়ানো হতে পারে।

ঋণ বাড়বে, তবে বিলাসিতা নয়

বাজেটে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়লেও তা মেগা প্রকল্পের জন্য নয়। বরং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ঘাটতি পূরণ, অতীতের ব্যয়ের দায় মেটানো এবং রুরাল রিকভারিতে খরচ করতেই এই ঋণ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

অর্থ উপদেষ্টা মনে করছেন, দেশের ঋণ ঝুঁকি ‘মাঝারি’ থেকে ‘নিম্নে’ নামিয়ে আনার চেষ্টা চলবে। তবে আগের সরকারের রেখে যাওয়া দেনার বোঝা স্বীকার করেই তিনি বলছেন, ‘ঋণ নিয়ে হলেও গুছিয়ে নিতে হবে।’

চ্যালেঞ্জের মুখে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ

এবারের বাজেট এমন এক সময় আসছে, যখন বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপ করে রফতানির ওপর চাপ তৈরি করেছেন। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। মেশিনারিজ আমদানি ও এলসি খোলার হার কমে গেছে, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়।

সংকট থেকে উত্তরণে রূপরেখা জরুরি

অর্থনীতিবিদদের মতে, এ বাজেট যতই বাস্তবধর্মী হোক না কেন, তা সফল করতে হলে একটি সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের রূপরেখা দিতে হবে। শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, বাজেট হতে পারে দেশ পুনর্গঠনের দিকনির্দেশক।

অবশ্য অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই বাজেট হতে যাচ্ছে একটি নতুন সূচনা; যেখানে থাকবে না বিভ্রমের ঝলক, বরং কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে একটি সংকটে পড়া অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত