বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিল্প খাত এক বহুমাত্রিক সংকটে পড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, বিনিয়োগে ভাটা, প্রশাসনিক হয়রানি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাপে থমকে গেছে শিল্পায়নের চাকা। উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, শিল্পের ওপর যেন ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ চলছে। এর ফলে বিনিয়োগে স্থবিরতা এসেছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে দাঁড়িয়েছে। এতে তৈরি হচ্ছে সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা।
দেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরাও নানা তদন্ত ও মামলার সম্মুখীন হচ্ছেন। ব্যাংক হিসাব জব্দ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য সংস্থার বারবার তলব, এমনকি অনেক সময় রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ তুলে ব্যবসায়ীরা বলছেন—এটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
একাধিক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের (যেমন হত্যা) অভিযোগে মামলা দায়ের হচ্ছে, যা বাস্তবতা বিবর্জিত। এতে তারা বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, ফলে নতুন কর্মসংস্থানও থমকে গেছে।
আমদানি কমছে, থেমে যাচ্ছে শিল্পায়ন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) শিল্প পণ্যের আমদানিতে এলসি খোলা ও সেটেলমেন্ট—দুই ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পতন দেখা গেছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তথ্য
টেক্সটাইল যন্ত্রপাতি: এলসি খোলা কমেছে ১৬.০৭% এবং সেটেলমেন্ট কমেছে ২১.৬৬%
চামড়াশিল্প: এলসি খোলা কমেছে ১৮.১৮%, তবে সেটেলমেন্ট সামান্য বেড়েছে (২.৪৬%)।
ওষুধশিল্প: এলসি খোলা কমেছে ২১.৪৪%, সেটেলমেন্ট কমেছে ৪২.৫২%।
প্যাকেজিং উপকরণ: এলসি খোলা কমেছে ৩৫.৫২%, সেটেলমেন্ট কমেছে ৩৭.৬৯%।
কাঁচা তুলা: এলসি খোলা কমেছে ৯.২৯%, সেটেলমেন্ট কমেছে ২.৫৩%।
সব মিলিয়ে শিল্প খাতের জন্য মূলধন যন্ত্রপাতি, কৃষি যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার হার্ডওয়্যারসহ গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
শুধু পাট খাত কিছুটা ব্যতিক্রম, যেখানে এলসি খোলা বেড়েছে ৫৩.৮৪%। তবে সেটেলমেন্ট সেখানে কমেছে ১৪.৫৮%।
পোশাক খাত তুলনামূলক স্থিতিশীল
দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও তা সামগ্রিক শিল্প খাতকে টেনে তুলতে পারছে না। এই খাতে এলসি খোলা বেড়েছে ২০.৭৪% এবং নিষ্পত্তি বেড়েছে ৫.৬০%।
মূলধন যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাচ্ছে
২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত এলসি খোলার পরিমাণ ২৮.৬৮% কমে ১,৮০৪ মিলিয়ন ডলার থেকে ১,৩৩৫ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে সেটেলমেন্ট কমেছে ২৩.৮৬%, যা ২,১৩৩ মিলিয়ন ডলার থেকে নেমে এসেছে ১,৫২১ মিলিয়ন ডলারে।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল) প্রথম ১০ মাসে নিবন্ধিত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্পের সংখ্যা ৮১৪টি, যার প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ২৭ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় কম, অর্থাৎ বিনিয়োগ পরিস্থিতিও নেতিবাচক।
শিল্পমালিকরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট, সুদের হার ১৮ শতাংশে পৌঁছানো, রফতানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ শুল্ক, নগদ প্রণোদনা হ্রাস এবং টাকার অবমূল্যায়নের ফলে উৎপাদন ও রফতানি উভয় খাতে বিপর্যয় চলছে।
ব্যবসায়ীদের সতর্ক বার্তা
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গার্মেন্টস, চামড়া, ওষুধ এবং অন্যান্য রফতানিমুখী খাতে চলমান গ্যাস সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিদ্যমান শিল্পও আর্থিক সংকটে পড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর।
শিল্প মালিকরা বলছেন, চলতি মূলধন সংকুচিত হয়ে পড়ায় আসন্ন ঈদুল আজহার আগে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দেওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় নগদ প্রবাহ কমে গেছে, অথচ ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন ১৩ শতাংশের কাছাকাছি, যা এই পরিস্থিতিতে বহন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলছেন, এই সংকট যদি অব্যাহত থাকে, তবে ঈদের পর অনেক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ যদি শোনা না যায়, তাহলে ঈদের পর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
বাংলাদেশ-থাই চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ব্যাংকগুলোকে শিল্প ঋণ না দিয়ে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, জ্বালানি সংকট, ব্যাংক অর্থায়নের ঘাটতি ও নীতিগত অসঙ্গতির কারণে শিল্প খাত রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘যেখানে আইনশৃঙ্খলা অনিশ্চিত, সেখানে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না।’ তিনি সরকারকে দ্রুত নিরাপত্তা ও আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ব্যবসার পরিবেশ দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। ‘অপরাধ, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের কারণে শুধু অর্থনীতি নয়, সমাজ ব্যবস্থাও চরম ঝুঁকির মুখে পড়ছে।’
ছোট উদ্যোক্তারা আরও পিছিয়ে
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (CMSME) সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন। ব্যাংক ঋণ বিতরণে বড় উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ায় ছোট উদ্যোক্তারা মূলধন সংকটে ভুগছেন। অথচ দেশের ৯৯% শিল্প ইউনিটই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘‘অনেক ব্যাংক শুধু মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছে, ক্ষুদ্রদের উপেক্ষা করছে।’’
২০২৯ সালের মধ্যে CMSME খাতে ব্যাংক ঋণের অংশ ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বর্তমানে তা ১৯ শতাংশের নিচে রয়েছে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া প্রবৃদ্ধি অসম্ভব: সিপিডি
২৭ মে এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি বলেছে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি— সবকিছুই ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে যে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ পৌঁছাতে পারে ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায়। মূল্যস্ফীতি ৬.৫% লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনা কঠিন হবে।
তারা অবিলম্বে নির্বাচন আয়োজনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অগ্রগতি, তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে চাপ
দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের পথে থাকলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখনও চাপে রয়েছে বলে জানিয়েছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, রফতানি ও প্রবাসী আয় রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হলেও ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরি পোশাকসহ রফতানি খাত কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে, তবে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে।
৯ মাসে এক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, গত ৯ মাসে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। একই সময়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৭৩৯টি নতুন প্রকল্প নিবন্ধন করা হয়েছে, যার মধ্যে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রকল্প ৬৬টি ও যৌথ বিনিয়োগের প্রকল্প ৬১টি।
রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক গতি
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ২০.৫৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মে মাসের প্রথম ২৪ দিনে দেশে এসেছে ২.২৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স, যা চলতি মাসে তিন বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড ছোঁয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স ও আমদানি নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভে চাপ কিছুটা কমলেও স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য রফতানি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।