দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ এখনো তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। পণ্যের বৈচিত্র্য নেই, বাজারের বিস্তার সীমিত আর বহু বছর ধরে চলে আসা প্রণোদনানির্ভর কাঠামো আজ পরিণত হয়েছে এক রকম নীতিগত আলস্যে। এলডিসি উত্তরণ সামনে রেখে এই একমুখী রপ্তানি প্রবণতা এখন বহুমুখী ঝুঁকির জন্ম দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে রপ্তানি ও আমদানিনীতির পুনর্মূল্যায়ন না করলে অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে।
গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে এমন উদ্বেগই উঠে এসেছে বক্তাদের বক্তব্যে। ‘বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা: এলডিসি-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয়তা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই আলোচনায় বেসরকারি খাত, নীতিনির্ধারক সংস্থা ও অর্থনীতিবিদেরা সরাসরি বলেছেন, বর্তমান নীতিমালায় কাঠামোগত দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে উত্তরণ-উত্তর বাস্তবতায় দেশ বড় বিপদে পড়তে পারে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা যে গতিতে কাঠামোগত সংস্কার করছি, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শুধু পরিকল্পনা নয়, বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে। এলডিসি উত্তরণ আমাদের জন্য গর্বের, কিন্তু প্রস্তুতির অভাবে সেটাই যেন দুর্বলতার প্রতীক না হয়ে দাঁড়ায়।’
চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি পণ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের—তৈরি পোশাক এবং তাও প্রধানত কয়েকটি নির্দিষ্ট বাজারে। চামড়া, ওষুধ, পাটজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য—এগুলোর রপ্তানির সুযোগ থাকলেও সেগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ করবেই, এখানে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। এখন চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে উত্তরণ-উত্তর বাস্তবতায় টিকে থাকব।’ তিনি জানান, খুব শিগগিরই একটি জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
এনবিআর সদস্য (কাস্টমস) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি এক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় আন্তর্জাতিক দর-কষাকষিতে পিছিয়ে পড়ছি। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী বাণিজ্য আলোচনায় বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা উচিত।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নগদ প্রণোদনা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর নীতিসহায়তা বেশি প্রয়োজন। রপ্তানিতে বহুমুখীকরণ আনতে নন-ট্রেডিশনাল খাতগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি জানান, কমপ্লায়েন্স, স্ট্যান্ডার্ড এবং নীতিমালার পুনর্গঠন এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে সরকার কাজ করছে।
মূল প্রবন্ধে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা এখনো উচ্চ শুল্ক ও প্যারা-ট্যারিফ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছি। সরাসরি কর আহরণে সরকারের ব্যর্থতা আমদানি কর এবং ভ্যাটের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা তৈরি করেছে।’ তিনি মনে করেন, তৈরি পোশাক খাতভিত্তিক প্রণোদনার বাইরে গিয়ে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে এমন কথা নেই, তবে উচ্চমূল্য সংযোজন ও মানসম্মত উৎপাদনে মনোযোগ না দিলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’
ফকির ফ্যাশনের এমডি ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, ‘জিএসপি-সুবিধা চলে গেলে তৈরি পোশাক পণ্যের দাম অন্তত ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে, যা আমাদের জন্য বড় বিপদ। বন্দর ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন ও দক্ষতা বাড়াতে না পারলে লিড টাইম আরও বাড়বে।’
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের পক্ষে ডেলটা ফার্মার এমডি ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ট্রিপস সুবিধা ২০২৬-এর পর আরও অন্তত ছয় বছর যেন অব্যাহত থাকে, তা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই কার্যকর নেগোসিয়েশন দরকার।’