Homeঅর্থনীতিএনবিআরের ভাঙন ঘিরে অর্থনীতিতে স্থবিরতা

এনবিআরের ভাঙন ঘিরে অর্থনীতিতে স্থবিরতা


জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দেশের কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে আসছিলেন। এর ফলে দেশের প্রধান প্রধান বন্দরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ে। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়াসহ শিল্প উৎপাদন ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এনবিআর কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তীব্র হওয়ায় দেশের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হওয়ার উপক্রম হয় এবং পরিস্থিতি ক্রমেই গভীর হচ্ছিল।

তবে রাজস্ব খাত সংস্কার নিয়ে উদ্ভূত সংকটের প্রেক্ষাপটে সরকারের আশ্বাসে কর্মবিরতি স্থগিত করেছে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘জাতীয় রাজস্ব ঐক্য পরিষদ। রবিবার (২৫ মে) রাতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত জানায় সংগঠনটি।

আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির অধ্যাদেশটি সংশোধনের আশ্বাস দেওয়া হয়। জানানো হয়, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংশোধন করে এনবিআরকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগে রূপান্তর করা হবে।

এছাড়া রাজস্ব নীতি পৃথকীকরণের কাঠামো কীভাবে প্রণীত হবে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

সরকার পক্ষ আরও জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৫’ কার্যকর করা হবে না। এতে আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের প্রধান আপত্তির বিষয়টি আপাতত নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

জাতীয় রাজস্ব ঐক্য পরিষদের নেতারা জানিয়েছেন, সরকারের লিখিত আশ্বাস ও আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে কর্মবিরতি কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে অংশীজনদের সম্মতিতে একটি টেকসই কাঠামো গঠনের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন তারা।

এর আগে কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে শনিবার (২৪ মে) দেশের প্রধান বন্দরগুলোতে আমদানি কার্যক্রম কঠোরভাবে ব্যাহত হয়। কারণ এনবিআর ভাঙার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কর্মকর্তারা তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ ঘোষণা করে—২৬ মে থেকে আমদানি-রফতানিসহ সব শুল্ক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, কেবল আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহন চলবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে স্বল্প মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে।

শিল্প খাতে বিপর্যয়

গার্মেন্টস ও অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্প খাতে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। বিদেশি ক্রেতারা বিলম্বিত চালানে ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন, কেউ কেউ অর্ডার বাতিলও করছেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, চট্টগ্রাম চেম্বারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা দ্রুত সমস্যার সমাধানে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, কর্মকর্তাদের দাবি যৌক্তিক হলে সরকারকে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। সংকট নিরসনে আলোচনা জরুরি, যাতে বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল থাকে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, প্রয়োজনে অধ্যাদেশটি স্থগিত রাখা উচিত। কারণ, এই অচলাবস্থা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে এবং অর্ডার কমার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

রাজস্ব বোর্ডে অচলাবস্থা

শনিবার (২৪ মে) চট্টগ্রাম, বেনাপোল, ঢাকা কাস্টম হাউজসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমদানি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৩ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত চার হাজারের বেশি কনটেইনার আটকে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেবল চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকেই ৬৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে, এই অচলাবস্থার ফলে যা বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়ে।

রফতানিকারকদের উদ্বেগ

ক্রেতারা সরবরাহ বিলম্বের কারণে অসন্তুষ্ট, যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম কমিয়ে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক ও নীতিগত স্থিতিশীলতার অভাবে নতুন বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

প্রতিদিন ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) জানিয়েছে, প্রতিদিন গড়ে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি আদেশ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বন্দরে আটকে আছে হাজার হাজার কনটেইনার—যার মধ্যে রয়েছে পচনশীল খাদ্যপণ্য, ওষুধ, শিল্পের কাঁচামাল এবং ই-কমার্স পণ্য।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম  জানান, শনিবার (২৪ মে) সারা দেশে আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম কার্যত বন্ধ ছিল ।

চট্টগ্রাম সি অ্যান্ড এফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম সাইফুল আলম বলেন, ‘ধর্মঘটের কারণে বন্দর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় আমদানিকারকদের বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।’

রাজস্ব আদায়ে ধস

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ সাধারণত দৈনিক ১৯০০ থেকে ২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে কার্যত সব রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ৩.২ মিলিয়ন কনটেইনার পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালে এখানে ৩.২৭৬ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার ও ১২৪ মিলিয়ন টন পণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৭৮.৭ মিলিয়ন টন পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় বেশি এবং ৬২,৮১৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। ১৩ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত আমদানি ছাড়পত্র স্থগিত থাকায় বন্দরে ৪ হাজারের বেশি কনটেইনার আটকে আছে।

মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি

বন্দরে পণ্য আটকে থাকায় বাজারে সরবরাহ কমে যাচ্ছিল। বিশেষ করে খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যে ঘাটতি তৈরি হলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈর হয়। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে।

বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছিল

বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক ও নীতিগত স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বর্তমানে বিঘ্নিত হচ্ছিল। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগের পূর্বশর্ত— এই আন্দোলন তা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা অন্যান্য দাতা সংস্থার আস্থা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

আমদানি-রফতানিতে ব্যাঘাত

চট্টগ্রাম বন্দর: দেশের ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হয় এখানে। ধর্মঘটের কারণে শনিবার (২৪ মে) বিকাল ৫টা পর্যন্ত বন্দর পুরোপুরি বন্ধ ছিল।

বেনাপোল কাস্টম হাউজ: সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকা, মোংলা, কমলাপুর ও অন্যান্য বন্দর: সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চলে।

কনটেইনার আটকা: ১৩ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার কনটেইনার বন্দরে আটকে আছে। এর মধ্যে রয়েছে পচনশীল খাদ্য, ওষুধ, শিল্প কাঁচামাল ও ই-কমার্স পণ্য।

এই পরিস্থিতি আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, যা সরবরাহ চেইনকে ব্যাহত করছে।

আন্দোলনের চার দফা দাবি

১. এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিল, ২. এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ, ৩. সংস্কার পরামর্শক কমিটির সুপারিশ প্রকাশ, ৪. অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

রবিবার সকাল থেকে এনবিআরে কর্মবিরতি, কার্যক্রম বন্ধ

এনবিআর বিলুপ্তির সরকারি অধ্যাদেশের প্রতিবাদে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আগারগাঁওয়ে কর্মবিরতি পালন করছেন। এতে এনবিআরের সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। অফিস প্রধান ফটক বন্ধ থাকায় গাড়ি ঢোকার ব্যবস্থা নেই, কর্মীরা হেঁটে অফিসে প্রবেশ করছেন। পুলিশ ও আনসার সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়। কর্মবিরতি চলাকালে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ ছিল, কিছু সিঁড়ি খোলা হলেও প্রধান ফটক বন্ধ ছিল।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের অফিসে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পূর্ণ কর্মবিরতি চলে।

উল্লেখ্য, এনবিআর ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত  কেবল একটি প্রশাসনিক সংস্কার ইস্যু নয়— এটি হয়ে উঠে অর্থনীতির জন্য একটি স্পষ্ট হুমকি। প্রতিটি দিন ক্ষতির অঙ্ক বাড়ছিল, আস্থা কমিয়ে দিচ্ছিল। শুধু তাই নয়, এনবিআর ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ঘিরে শুরু হওয়া আন্দোলন পুরো দেশের অর্থনীতিকে জিম্মি করে ফেলে। এটি শুধু প্রশাসনিক সংকট নয়, বরং সরাসরি আমদানি-রফতানি, রাজস্ব, মুদ্রাস্ফীতি, এবং ব্যবসায়িক আস্থায় বড় ধরনের আঘাত।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত