দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির রেখায় সাময়িক ওঠানামা থাকলেও মোটের ওপর তা জনজীবনকে স্বস্তি দিচ্ছে না। সরকার নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের একের পর এক সুবিধা দিলেও এর সুফল কাঙ্ক্ষিতভাবে ভোক্তার হাতে পৌঁছায়নি। আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা ব্যবসার পরিবেশকে করেছে নাজুক। ফলে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলছে না। বরং চাকরি হারানো মানুষের সারি প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। রপ্তানি, বিনিয়োগ, উৎপাদন কিংবা রাজস্ব—প্রায় সব খাতেই দুর্বলতা প্রকট, একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া নেই উল্লেখযোগ্য সুখবর।
অর্থনীতির এই হালের পেছনে সাবেক সরকারের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার দায়ের কথাও বলা হয়ে আসছে। তা কারণ যা-ই হোক, এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার (৭ লাখ ৯০ হাজার) বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এটাই প্রথম বাজেট এবং এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ৫৬তম বাজেট। সংসদ বিলুপ্ত থাকায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার সচিবালয়ে তাঁর নিজ দপ্তর থেকে এটি জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন ও বেতার ভাষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন।
সরকারের বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার আর্থিক নীলনকশা, যেখানে এক বছরের সম্ভাব্য আয় ও ব্যয়ের সুপরিকল্পিত পূর্বানুমান তুলে ধরা হয়। কোথা থেকে রাজস্ব আয় আসবে, কোন খাতে কী পরিমাণ ব্যয় হবে, কীভাবে ব্যয় হবে এবং তার উদ্দেশ্যই বা কী—সব মিলিয়ে বাজেট হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিচালনার প্রস্তাবিত কাঠামো।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষায়, অন্তর্বর্তী সময়ের এই বাজেট হবে ভারসাম্য ও আস্থার রূপরেখা, যা হবে বাস্তবভিত্তিক, বাস্তবায়নযোগ্য এবং সুশাসন ও বৈষম্য কমাতে সহায়ক।
বাজেট প্রণয়নে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ লক্ষ্যে ৬০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তব্যে যে আয়-ব্যয়ের নতুন হিসাব খুলতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা, তাতে মূল মনোযোগের বিষয়ই থাকবে মূল্যস্ফীতি। থাকবে কিছু নীতিগত অগ্রাধিকারের মাধ্যমে চাপ কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ফেরানোর উদ্যোগ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং সামাজিক সুরক্ষামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে আয়বর্ধক ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সম্প্রসারণের বিষয়ে বাজেটে থাকবে পরিষ্কার বার্তা।
সরকার ব্যয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তার বড় অংশই—৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে চায় অভ্যন্তরীণ কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির মাধ্যমে। এর মধ্যে এনবিআর উৎস থেকে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছে বিভিন্ন খাত থেকে কর অব্যাহতি কমিয়ে। বাকি ৪৬ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআর-বহির্ভূত কর খাত থেকে। এ জন্য নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে করকাঠামোয় ব্যাপক সংস্কার, কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে সরে আসা এবং ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। করজালের আওতাও সম্প্রসারণের উদ্যোগ রাখা হচ্ছে।
বাজেটটি আত্মনির্ভর না হওয়ায় সম্ভাব্য ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতির পুরোটাই আসবে ঋণ থেকে। এর মধ্যে বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। আর দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৬ হাজার কোটি টাকা আসবে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও দাতাদেশগুলোর দেওয়া অনুদান থেকে।
এ প্রসঙ্গে বিআইডিএসএর সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি আজকের পত্রিকাকে জানান, ‘সরকার যে আকারে বাজেট দিচ্ছে, তা বাস্তবতাসম্মত। তবে বাজেট যত ছোটই হোক না কেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিনই থেকে যাবে।’
এ অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা, ব্যাংক খাতে ঘাটতি অর্থায়নের চাপ পড়লে তারল্যসংকট বাড়বে, ফলে টাকা ছাপানোর আশ্রয় নিতে হতে পারে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালবে সরকার নিজেই।
অন্যদিকে অতীতে ঋণ করে বড় আকারের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগের কারণে অনেক বেড়েছে বৈদেশিক দায়ের বোঝা। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণের দায় বয়ে বেড়াচ্ছে দেশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এ দায় পরিশোধেরও বাধ্যবাধকতা থাকছে। এ জন্য আগামী বাজেটে সরকারি পরিচালন ব্যয়ের ১৭ শতাংশ বা ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকাই বরাদ্দ রাখা হচ্ছে আগের ঋণ ও সুদ পরিশোধে।
এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও নতুন করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার জন্য সরকার ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার লক্ষ্যে বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। আর সরকারি দাপ্তরিক কাজের সামগ্রী ক্রয় ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় করা হবে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা।