Homeঅর্থনীতিদিনে দিনে বাড়ছে নারী উদ্যোক্তা

দিনে দিনে বাড়ছে নারী উদ্যোক্তা


বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা এসএমই খাতের মাধ্যমে শুধু নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই অর্জন করছেন না; বরং দেশীয় প্রবৃদ্ধি, লৈঙ্গিক সমতা ও সামাজিক রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রতিকূল আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে, পারিবারিক চাপে কিংবা ধর্মীয় কুসংস্কার ছাপিয়ে নারী উদ্যোক্তারা যে সাহস ও দৃঢ়তায় ব্যবসায় এগিয়ে চলেছেন, তা দেশীয় অর্থনীতির গতিপথে নতুন মাত্রা যুক্ত করছে।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ এসএমইর মধ্যে মাত্র ৬.৪৭ শতাংশ নারীদের মালিকানাধীন হলেও উদ্যোক্তা সৃষ্টির হারে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১৬.৬৭ শতাংশই নারী, যাঁদের বড় অংশ জড়িত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা কার্যক্রমে। এই অবদানের স্বীকৃতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পর্যালোচনা জরিপে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসে ১ লাখ ৬০ হাজার পুরুষ দরিদ্র হলেও এ সময়ে একজন নারীও নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় পড়েননি। বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির ধারা।

পোশাকশিল্প থেকে শুরু করে হ্যান্ডিক্রাফটস, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ব্যাংকিং, টেলিকম—প্রায় সব খাতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সৌন্দর্যশিল্পে নারীদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি—এ খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ উদ্যোক্তাই নারী এবং তাঁদের কর্মক্ষেত্রেও নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ ছাড়া প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক নারী উদ্যোক্তা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বাঁশ ও মাটির তৈজসপত্র তৈরি, ব্লক ও বুটিকের মতো হস্তশিল্পে নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।

এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নতুন উদ্যোক্তার ৬০ শতাংশই নারী। ফাউন্ডেশনটি ৫০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা সাপ্লায়ার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা, করপোরেট বায়ারের সঙ্গে সংযোগ তৈরি এবং ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ—এসব উদ্যোগ নারীদের ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

সমাজ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ দক্ষতা ও সক্ষমতা তাঁদেরকে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই সচ্ছলতা এনে দিচ্ছে না, পাশাপাশি সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব প্রদানের পথও তৈরি হচ্ছে। এভাবে তাঁরা ক্রমেই পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারও অর্জন করছেন। এ সক্ষমতা নারীর মর্যাদাকে যেমন আরও সুদৃঢ় করেছে, বিশেষ করে পরিবার ও সমাজের কাঠামোগত ব্যবস্থায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীরা কেবল মতপ্রকাশেই সক্রিয় নন; বরং তাঁদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্দৃষ্টি অনেককে অনুপ্রাণিত করে, যা সমষ্টিগত কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে নারী নেতৃত্ব সমাজে এক নতুন মানবিক ও সমতানির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটাতে সহায়ক হয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান আজকের পত্রিকাকে জানান, আসন্ন বাজেটে নারীদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তার লক্ষ্যে একটি বিশেষ তহবিল গঠনের ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের পণ্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজারজাত করতে ফাউন্ডেশন সব ধরনের সহায়তা করছে। তাঁদের স্বার্থে আমরা সরকারের কাছে আরও নীতিসহায়তা চেয়েছি। এমনকি নারী এসএমইদের ৫০ শতাংশ পণ্য সরকারকে কেনারও প্রস্তাব দিয়েছি। এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে দ্রুত নারী উদ্যোক্তা আরও বাড়বে’—আশা প্রকাশ করেন তিনি।

অন্যদিকে বাস্তবতায় নানা প্রতিবন্ধকতা এখনো রয়ে গেছে। রাজশাহী উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রোজেটি নাজনীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ না পাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। সঠিক যোগাযোগ ছাড়া এখনো ব্যাংক থেকে সহায়তা পাওয়া যায় না।’ তিনি অঞ্চলভিত্তিক প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা না হওয়া পর্যন্ত পেছনে থেকে সহায়তা এবং বাজার সম্প্রসারণের জন্য ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

নারী উদ্যোক্তা বিলকিছ ওয়াজি ঝিনুক তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘এ্যাপোনিয়া’র অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, এসএমই ফান্ডে বরাদ্দ থাকলেও অনেক সময়ই সহায়তা পাওয়া যায় না। আবার এসএমইর সংজ্ঞা একেক মন্ত্রণালয়ে একেক রকম হওয়ায় সুবিধা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার নীতিগত সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যা বাস্তবায়নে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তিনি জানান, নারী উদ্যোক্তারা যাতে কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই সহজে ঋণসুবিধা পান, সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নীতি অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে ঋণ বিতরণের মোট পরিমাণের অন্তত ২৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখতে বলা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ নির্ধারিত রয়েছে এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। এই বরাদ্দের বাস্তবায়ন নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং প্রতি মাসেই ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যারা লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পিছিয়ে রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও ই-কমার্স খাতেও নারীরা উল্লেখযোগ্যভাবে অংশ নিচ্ছেন। বর্তমানে অনলাইন উদ্যোক্তাদের প্রায় অর্ধেকই নারী, যাঁরা ঘরে বসেই মাসে হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুগের পরিবর্তনে নারীরা এখন ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। সরকারের উচিত ইন্টারনেট সেবা আরও সহজলভ্য করা।’

এসব উদ্যোগ ও সহায়তার ফলেই ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস ২০২৩’-এ বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৪টি স্বল্প আয়ের দেশের মধ্যে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। দেশে বর্তমানে উদ্যোক্তার ৩১.৬ শতাংশই নারী, যা একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়।

নারীর নেতৃত্বে যে আর্থসামাজিক রূপান্তর ঘটছে, তার পেছনে এসএমই খাত একটি নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। এখাতের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা, নীতিগত সমন্বয় এবং প্রযুক্তি সহায়তা নিশ্চিত করা গেলে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কেবল সমৃদ্ধই হবে না; বরং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত