দুর্বল ব্যাংককে আর টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেওয়া হবে না, দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিকবার এমনটাই বলেছিলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু সেই কথায় অনড় থাকতে পারেননি তিনি। পূর্বসূরিদের মতো তিনিও টাকা ছাপিয়ে ‘ব্যাংক বাঁচানোর’ পথ অনুসরণ করে চলেছেন। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংককে সহায়তার এই পথটা ঠিক নয়। এতে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করা তো যাবেই না, উল্টো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে টাকা ছাপানো, গ্যারান্টি ও বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া মোট সহায়তার পরিমাণ ৫৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঈদের দুই কার্যদিবস আগেও ৫টি ব্যাংককে ৩ হাজার কোটি ছাপানো টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংককে ১ হাজার কোটি, এবি ব্যাংককে ৫০০ কোটি, বেসিক ব্যাংককে ৫০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংককে ৫০০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংককে ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়।
তীব্র তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংককে ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোটের বিপরীতে ১০ শতাংশ সুদে ৯০ দিনের জন্য টাকা ছাপিয়ে পাঁচ ব্যাংককে এই ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত প্রচলিত জামানত না থাকায় ‘টাকা ছাপিয়ে’ এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। এতে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে, এমন আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পর্ষদ পরিবর্তনেও তারল্যসংকটে ভুগছে এসব ব্যাংক। আমানতের টাকা তুলতে ব্যাংকগুলোর শাখায় শাখায় ধরনা দিচ্ছেন গ্রাহকেরা, কিন্তু টাকা দিচ্ছে না ব্যাংক। এ অবস্থায় গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক জামানত ছাড়াই ৫৩ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় ব্যাংকগুলোকে। এতেও গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
ন্যাশনাল ব্যাংকের রাজধানীর লেক সার্কাস শাখার গ্রাহক শামীমা আফরোজ জানান, তিনি ন্যাশনাল ব্যাংকে টাকা রেখে তুলতে পারছেন না। ব্যাংক বারবার সময় দেয়, কিন্তু টাকা দেয় না। এবার জানিয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা পেলে টাকা দেবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা দেয় গোপনে, যা ব্যাংক অন্যান্য কাজে ব্যয় করে। গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করে না।
ইউনিয়ন ব্যাংকের মতিঝিল শাখার গ্রাহক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা রেখে মহাবিপদে আছি। মাত্র ৫ লাখ টাকাও তুলতে পারছি না। ব্যাংকের কাছে ১ লাখ টাকার চেক দিলেও তা ক্যাশ করেনি। এতে কোরবানি দেওয়া হলো না।’ একই অভিযোগ গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক বায়োজিদের। আর এবি ব্যাংকও বড় গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও লুকোচুরি খেলছে বলে অভিযোগ করেছেন গ্রাহকেরা। গত ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে গোপনে টাকা ছাপিয়ে ছয় দুর্বল ব্যাংককে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেন। তিনি সেদিন জানান, ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজন হলে আরও দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক। মূলত গোপনে টাকা দেওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘গোপনে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়’ বলাটা ঠিক না। বিষয়টি এমনভাবে না দেখাই ভালো। নিয়মকানুন মেনে সহায়তা দেওয়া হয়। কোরবানির ঈদের আগের ৫টি ব্যাংকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। টাকা ছাপিয়ে দেওয়া ছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তার অন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে এসব করা হয়েছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সেপ্টেম্বর থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেওয়া শুরু করেছে। প্রথম ধাপে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার পায় ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির মাধ্যমে ৯০ দিনের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা ধার পায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এক্সিম, এনবিএল, এসআইবিএল ব্যাংক। ধার দেয় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি, ডাচ্-বাংলা, বেঙ্গল ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। আর গত নভেম্বরে ৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা পায় দুর্বল ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯২০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৭০০ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ৪০০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২৯৫ কোটি টাকা পেয়েছে। এই তারল্য সহায়তা দিয়েছে সোনালী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইস্টার্ন, শাহজালাল ইসলামী, সিটি, ব্র্যাক, পূবালী, ঢাকা ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। এভাবে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলো।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কোনো কোনো ব্যাংকে তারল্যসংকট হয়েছে, তাদের টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা থাকে না। এর প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। জিনিসপত্রের দাম উসকে যাওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।