Homeঅর্থনীতি‘নগদ’ কে চালায়, কীভাবে চলে, যা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

‘নগদ’ কে চালায়, কীভাবে চলে, যা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক


মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস খাতে আলোচিত সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে বহুদিন ধরেই রয়েছে বিতর্ক। এবার বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানালো, ‘নগদ’ কার্যত কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই। বরং সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যার কার্যক্রমে মিলছে নানা অনিয়মের প্রমাণ।

গত সোমবার (১২ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দফতর থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর একটি চিঠির জবাবে এ ব্যাখ্যাটি প্রদান করা হয়। বিশদ ব্যাখ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে কীভাবে শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ‘নগদ’ পরিচালিত হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির আইনি কাঠামো গড়ে ওঠেনি।

অস্থায়ী অনুমোদনে ৪ বছর ধরে চলছে নগদ

‘নগদ’ চালু হয় ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ, তবে তখন কোনও অনুমোদন ছিল না। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের দাবি, এটি তাদের উদ্যোগে পরিচালিত একটি সরকারি প্রকল্প। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি কোনও আইনি ভিত্তি ছাড়াই দীর্ঘদিন চালু ছিল।

২০২০ সালের ১০ মার্চ ডাক বিভাগ ‘নগদ’-এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে লাইসেন্সের আবেদন করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডাক বিভাগের অংশগ্রহণে পরিচালিত এমএফএস’ হিসেবে নগদকে একাধিকবার অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দেয়। সর্বশেষ অনুমোদন নবম দফায় ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এত বছরেও ডাক বিভাগ ‘নগদ’-এর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইনি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করেনি। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালে সংশোধিত রেগুলেশন জারি করে জানিয়েছে— সরকারি অংশীদারত্বে এমএফএস পরিচালনার ক্ষেত্রে ৫১ শতাংশ মালিকানা থাকতে হবে এবং তা লিখিত ও চুক্তিভিত্তিক হতে হবে।

সরকারি মালিকানা শুধু নামে, বাস্তবে নেই কোনও নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যায় বলা হয়, নগদ কার্যত সম্পূর্ণভাবে একটি বেসরকারি কোম্পানি। যা নগদ লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, আগে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড নামে পরিচিত ছিল। এই কোম্পানিকে “মাস্টার এজেন্ট” হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বলেও ডাক বিভাগ দাবি করে।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য, তারা এই নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও বৈধ চুক্তিপত্র কখনও দেখেনি। চুক্তিপত্র ছাড়া কীভাবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রাহক অর্থ, প্রযুক্তি, অ্যাকাউন্টিং, মার্কেটিং এবং মানবসম্পদসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে—সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এসেছে, ‘নগদ’ কার্যক্রমের অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক কোনও কর্মকাঠামো ডাক বিভাগের ভেতরে বিদ্যমান নেই। বরং প্রতিষ্ঠানটির অফিস, সার্ভার, অ্যাপ, এমনকি ব্যাংক হিসাবও বেসরকারি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।

ই-মানি বনাম রিয়েল মানি: ভয়াবহ গরমিল

২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়ে যে, ‘নগদ’-এর ই-মানি (ইলেকট্রনিক মানি) ব্যালেন্স তাদের ব্যাংকে রাখা রিয়েল মানির চেয়ে ১০১.৩৬ কোটি টাকা বেশি। যা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবার নিয়ন্ত্রণনীতি অনুযায়ী সরাসরি অবৈধ।

বাংলাদেশ ব্যাংক তখনই এই ঝুঁকি মোকাবিলায় ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করে। পরবর্তী সময়ে ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়।

এরপরও পর্যালোচনায় উঠে আসে আরও বিস্ময়কর তথ্য—‘নগদ’ অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করেছে, যার বিপরীতে কোনও রিয়েল মানি জমা দেওয়া হয়নি। ফলে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সরকারি কোষাগারও ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়ে।

ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টও ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে

‘নগদ’ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত যে ট্রাস্ট-কাম-সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট (টিসিএস) ব্যবহার করার কথা, সেটিও আগে ছিল নগদ লিমিটেডের নামে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে এটি ডাক বিভাগের নামে রূপান্তর করা হয়। অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ জমা না রেখে দীর্ঘদিন বেসরকারি কোম্পানির নামে গ্রাহকের অর্থ জমা রাখা হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে ‘অনুমোদনের শর্ত লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখসহ একাধিকবার সতর্ক করেছে।

দায় চাপানো ও গা-ঢাকা দেওয়া কর্মকর্তারা

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, নগদ লিমিটেডের নিয়ন্ত্রক পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি তদন্ত চলাকালে ‘গা-ঢাকা’ দিয়েছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে সহযোগিতা করেননি। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে আইনি কাঠামোতে আনা এবং ভবিষ্যতে গ্রাহকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।

নিয়ন্ত্রণহীন ডিজিটাল সেবা কি গ্রাহকের জন্য নিরাপদ?

‘নগদ’ ইস্যু শুধু একটি কোম্পানির অনিয়ম বা লাইসেন্সজনিত জটিলতা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল ফিন্যান্স ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির চিত্র স্পষ্ট করে।

সরকারি নামের আড়ালে বেসরকারি কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ, অডিট না থাকা, ই-মানি ও গ্রাহক অর্থে গরমিল এবং কোনও চুক্তি ছাড়াই কোটি কোটি টাকা লেনদেন—এসব প্রশ্ন শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়, বরং দেশের কোটি গ্রাহকের, যাদের অর্থ এই সেবার ওপর নির্ভর করে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত