ঢাকার ডেমরার বাসিন্দা হালিমা ২০১১ সালে ইডেন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষিত, সক্ষম ও স্বপ্নশীল এই তরুণী আশা করেছিলেন ভালো চাকরি করে মা-বাবার সংসারে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু বাস্তবতায় ভিন্ন রঙে আঁকা হয়েছিল তাঁর জীবন। বিয়ের পর চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে ল পাস করেও সংসার ও সন্তান পালনে আটকে গেছেন তিনি।
স্বামী যখন চাকরিতে ব্যস্ত, তখন পুরো গৃহস্থালির দায়িত্ব হালিমার কাঁধে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের কাজ আর ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া, এভাবেই কাটে তাঁর দিন। অথচ তাঁর অনেক সহপাঠী এখন ভালো চাকরি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। হালিমা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার শিক্ষা ও দক্ষতা আছে, বাইরে গিয়ে কাজ করতে চাই। কিন্তু নানা বাধা আমার স্বপ্নকে আটকে রেখেছে। তা ছাড়া যে কাজ আমি ঘরে করছি, তার কোনো আর্থিক স্বীকৃতি নেই।’
হালিমার মতো হাজারো শিক্ষিত নারী গৃহস্থালি শ্রমের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২১ সালের একটি জরিপ বলছে, নারীদের অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে দেশের জিডিপির প্রায় ১৪.৮ শতাংশ। এর বিপরীতে পুরুষদের অবৈতনিক গৃহস্থালি শ্রমের মূল্য জিডিপির ২.৮ শতাংশ।
এই অবমূল্যায়িত অবৈতনিক শ্রমকে আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করে জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ এসেছে প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে। ২ জুন উপস্থাপিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা করেন, হোমমেকার নারীদের শ্রমের আর্থিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘কর্মজীবী নারীদের পাশাপাশি গৃহস্থালি শ্রম দেওয়া নারীদের অবদানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেক দিন ধরে অবমূল্যায়িত ছিল। এই স্বীকৃতি তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীর গৃহস্থালি শ্রমকে জাতীয় আয় ও জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘এটি সময়ের দাবি এবং নারীর শ্রমের যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়ার পথ খুলবে। তবে পদ্ধতিগত ও মানদণ্ড নির্ধারণে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন, যাতে এটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনাম বলেন, ‘১৫ বছর ধরে নারীদের অস্বীকৃত কাজের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছি। স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গৃহস্থালি কাজের মূল্য নির্ধারণ করে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে, তা হবে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।’
অন্যদিকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সংগঠন আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার বলেন, জাতীয় বাজেটে নারীর অবৈতনিক, অস্বীকৃত সেবা ও গৃহস্থালি কাজের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা দেশের জন্য যুগান্তকারী নীতিগত পরিবর্তন।
বিআইডিএসের জরিপ অনুযায়ী, নারীর অবৈতনিক সেবামূলক কাজের আর্থিক মূল্য তাঁদের বেতনভুক্ত শ্রম থেকে প্রাপ্ত আয়ের চেয়ে প্রায় ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ বেশি। অর্থাৎ নারীর গৃহস্থালি শ্রমের অবদান দেশের অর্থনীতির অনন্য সম্পদ, যা এখন থেকে আংশিক হলেও স্বীকৃতির স্বাদ পাবে।
এই উদ্যোগে খুশি হয়েছেন দেশের নারীরা। তাঁরা আশা করছেন, এই স্বীকৃতি নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করবে এবং তাঁদের ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে নতুন গতি আনবে।