যখন এআই, অটোমেশন আর ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবসা বদলে দিচ্ছে সারা বিশ্বে, তখন বাংলাদেশের এসএমই খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা এখনো খাতা-কলমে হিসাব রাখেন, হাতে করে অর্ডার সামলান, আর ফেসবুকে ছবি পোস্ট করাকেই ধরেন ডিজিটাল বিপণন। জিডিপির প্রায় এক-চতুর্থাংশে অবদান রেখেও এই খাতের ৯৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির বাইরে। তথ্য নেই, দিকনির্দেশনা নেই, দক্ষতা তৈরির সুযোগও সীমিত; ফলে আধুনিক ব্যবসার মূলস্রোতের সম্পর্ক ছিন্ন তাদের। প্রযুক্তিবিশারদেরা বলছেন, ব্যবসায় প্রযুক্তি এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং টিকে থাকার শর্ত। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়া মানেই শুধু নিজের ক্ষতি নয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধিকেও টেনে ধরা।
জাতীয় এসএমই নীতিতে প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। উদ্যোক্তারা জানেন না কী প্রযুক্তি প্রয়োজন, কোথায় পাবেন, কীভাবে শুরু করবেন। তথ্য, পরামর্শ ও অর্থের ঘাটতিতে প্রযুক্তি তাঁদের কাছে এক দুর্লভ ও জটিল বিষয়। সহনীয় কর-ভ্যাটের অভাব এবং অব্যাহতির সংকোচন প্রযুক্তি খাতে অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে আইসিটির ২৭টি খাত করমুক্ত ছিল, ২০২৪-২৫ সালে তা কমে ১৯-এ নেমেছে। ফলে ৮৫% কর্মসংস্থান জোগানো খাতটি এখনো প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির শুরুতেই আটকে আছে।
এসবের প্রভাব পড়ছে উৎপাদন ও ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে। দেশের এসএমই খাত, প্রযুক্তির ঘাটতিতে প্রতিবছর ৩-৫ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, এই তথ্য বিশ্বব্যাংকের। বিপরীতে, সঠিক নীতি ও ডিজিটাল ব্যবস্থায় এই খাত থেকে ৮-১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সম্ভব। বিআইডিএস বলছে, যারা প্রযুক্তি এনেছে, তাদের বিক্রি বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানের বাস্তব উদাহরণ গাজীপুরের গ্রিন হ্যান্ড টেক্সটাইল। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাহফুজা ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রযুক্তি আমার অপচয় কমিয়েছে, মান ঠিক রেখেছে, আর বিদেশি ক্রেতা বুঝতে শিখিয়েছে। এতে আমার ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিও ভালো হচ্ছে।’
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রযুক্তি গ্রহণে দেরি হলে এসএমই খাত ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া এসএমই এগোতে পারবে না। উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে, আর সক্ষমদের সঙ্গে পাল্লায় না পেরে অনেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন। তাই প্রযুক্তিসেবা সহজলভ্য করতে সরকারেরই এগিয়ে আসা উচিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তি থেকে এসএমই খাতের বিচ্ছিন্নতা আত্মঘাতী। বিষয়টি সরকারের পরিকল্পনায় আছে। উদ্যোক্তারা যাতে সহজে প্রযুক্তি গ্রহণে এগোতে পারেন, সে জন্য দ্রুত কার্যকর কৌশল নেওয়া হবে।
জানা গেছে, থাইল্যান্ডে ৪০% এসএমই এরই মধ্যে আইওটি ও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে, মালয়েশিয়ায় ডিজিটাল স্কিলস প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। সরকার দেয় ভর্তুকিও। আর বাংলাদেশে প্রযুক্তি ব্যবহার ৫ শতাংশের নিচে, তা-ও শুধু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত। গ্রাম ও শহরতলির বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখনো রয়ে গেছেন অ্যানালগ পদ্ধতির মধ্যে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবিরের মতে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ক্লাউডভিত্তিক অ্যাকাউন্টিং ও ইনভেনটরি সফটওয়্যার অত্যাবশ্যক। সরকার স্বল্পমূল্যে এসব সরবরাহ করলে এসএমইরা সহজে প্রযুক্তিনির্ভর হতে পারে। অনলাইন বিক্রির জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল কমার্স ফ্রেমওয়ার্ক, যা অনেকের নেই। এ জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনে ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, নীতিগত সীমাবদ্ধতাগুলো এখনই পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।
তথ্য আছে, দৃষ্টি নেই
বাংলাদেশের এসএমই খাতে এখনো ডিজিটাল লেনদেন, ক্লাউড অ্যাকাউন্টিং বা সিআরএম সফটওয়্যার কার্যকরভাবে পৌঁছায়নি। প্রশিক্ষণ ও সহায়তা থাকলেও টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও পরামর্শের ঘাটতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার দৃশ্যমান নয়। অথচ প্রযুক্তি ছাড়া বাজার বোঝা, ক্রেতার চাহিদা ধরা বা খরচ নিয়ন্ত্রণ আজ অসম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের ‘এন্টারপ্রাইজ সার্ভে’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ১২% এসএমই ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে, যেখানে ভিয়েতনামে ৪১% আর ইন্দোনেশিয়ায় ৩৫%। এই ব্যবধানের মূল কারণ সরকারের প্রযুক্তি উদ্যোগ, কর নীতি ও দক্ষতা উন্নয়নে ঘাটতি।
নীতিমালার ফাঁকে আটকে সম্ভাবনা
বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিনির্ভর এসএমই বিস্তারে উদ্ভাবনী নীতি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। ফিলিপাইনে অনুদানের শর্ত ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, ঘানায় নারী উদ্যোক্তারা সরকারি অ্যাপে সংযুক্ত, ভিয়েতনামে গ্রামীণ এসএমইতে মোবাইল অ্যাপ বাধ্যতামূলক। এসব আর বিলাসিতা নয়, বাংলাদেশেও এখন সময়ের দাবি।
অথচ চলতি বাজেটেও এসএমই খাতে প্রযুক্তিগত রূপান্তরের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বরাদ্দ নেই। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কর রেয়াত, সফটওয়্যার ক্রয়ে ভ্যাট অব্যাহতি কিংবা প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রণোদনা—এসব দাবি বহুদিনের হলেও কানে পৌঁছায়নি নীতিনির্ধারকদের।
ডিসিসিআই সভাপতি সামীর সাত্তারের মতে, সহায়ক নীতিমালা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাই স্মার্ট অর্থনীতির পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে।
ঋণের পথেও প্রযুক্তি অন্তরায়
ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও প্রযুক্তিগত অনভিজ্ঞতা বড় বাধা। বাংলাদেশে এখনো ডিজিটাল স্কোরিং, বিকল্প তথ্যভিত্তিক ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্ট বা পিয়ার-টু-পিয়ার লেন্ডিং সেভাবে চালু হয়নি। অথচ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ছোট উদ্যোক্তারা মূলধনের সংস্থান নিশ্চিত করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রযুক্তি উন্নয়নে বরাদ্দ করা এসএমই ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ ব্যবহৃত হয় নতুন যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি আপগ্রেডে। মূলত প্রযুক্তির দাম, দক্ষ জনবল না থাকা এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাব—এসবই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেন, উদ্যোক্তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে প্রযুক্তি এখন অপরিহার্য। তথ্য ছাড়া ঝুঁকি নিরূপণ সম্ভব নয়, আর সেই তথ্য আসে প্রযুক্তি থেকেই। তাই উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল সক্ষমতা তৈরিতে নীতিগত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
প্রশিক্ষণের পরে পথ নেই
ভারতের ‘ডিজিটাল এমএসএমই স্কিম’-এ বছরে ৫ লাখ উদ্যোক্তা প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৫০ হাজার, তা-ও কাগজে-কলমেই। মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব নেই, কারণ, প্রশিক্ষণের পর নেই কার্যকর প্ল্যাটফর্ম, পরামর্শ বা টেক সাপোর্ট। ২০২৪-২৫ বাজেটে এসএমই খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নেই আলাদা বরাদ্দ বা প্রশিক্ষণ কোটা। নারী উদ্যোক্তারা আরও পিছিয়ে। এটি যেন মাঝপথে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেলে রাখার মতো অবস্থা।
নারী উদ্যোক্তারা এসএমই খাতের বড় অংশ হলেও তাঁরাই সবচেয়ে প্রযুক্তিবঞ্চিত। ডিজিটাল লেনদেন, ই-কমার্স বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবসার দক্ষতা বহুজনেরই নেই। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের মৃৎশিল্পী সালমা আক্তার বললেন, ‘আমি প্রতিদিন ৩০-৪০টা পণ্য বানাই, কিন্তু কোথায় বিক্রি করব, কীভাবে ছবি তুলব, পোস্ট করব—এসব শিখিনি। কেউ দেখায়ও না।’
প্রস্তুতির ঘাটতি স্পষ্ট
এসএমই ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ উদ্যোক্তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন নন, আর ৬৬ শতাংশ জানেন না কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস বা আইওটি ব্যবসায় কাজে লাগতে পারে। এই বাস্তবতায় প্রযুক্তি ধারণা ছড়িয়ে দিতে ‘টেকনোলজি লিটারেসি প্রোগ্রাম’ শুরু করেছে ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি আনোয়ার হোসেন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খাতটির সক্ষমতা তৈরিতে বড় পরিসরের পরিকল্পনা জরুরি।’
সমাধানের পথ: একটি সমন্বিত সেতু
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতিগত কাঠামো; যা প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন ও বাজার ব্যবস্থাপনাকে একসঙ্গে বেঁধে দেবে। এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমানের মতে, এ মুহূর্তে বাজেটভিত্তিক প্রযুক্তি নীতি, কর রেয়াত, সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্কছাড়, ডিজিটাল স্কোরিংয়ের মাধ্যমে সহজ ঋণ এবং আইসিটি বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে এসএমই খাতের টিকেa থাকাই কঠিন হবে।