Homeঅর্থনীতিব্যয় বাড়বে শিল্পে চাপ বাড়বে ভোক্তার

ব্যয় বাড়বে শিল্পে চাপ বাড়বে ভোক্তার


২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন আয়কর বাড়ানোর সঙ্গে স্থানীয় শিল্পে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। দেশীয় অনেক শিল্পে কর অব্যাহতি সুবিধাও তুলে নেওয়া হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খাতে চাপ বাড়বে।

বিপরীতে শুল্কনীতির সংস্কারের অংশ হিসেবে ৬২৬টি পণ্যের শুল্ক কমানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কঠিন শুল্কনীতির মোকাবিলায় ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হচ্ছে, যা বিদেশি পণ্যের আমদানি বাড়াবে। অন্যদিকে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়াবে।

শিল্প ও ব্যক্তিপর্যায়ে এই কর ও শুল্কনীতি দিন শেষে ভোক্তার পকেটের ওপর চাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। যদিও সরকারের দাবি, জনবান্ধব বাজেটই প্রণয়ন করা হচ্ছে এবার।

জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আগামী বাজেট গতানুগতিক হচ্ছে বলে মনে করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাজেট যেমন হওয়া দরকার ছিল, তা হচ্ছে না। দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ১০ শতাংশ লোকের হাতে চলে গেছে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল বাজেট হচ্ছে।’

সাধারণ মানুষের ওপর আসন্ন বাজেটের সম্ভাব্য প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ বাড়াবে না। কিন্তু আগের মতোই করের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর-শুল্ক বাড়লে স্থানীয় শিল্পও চাপে পড়বে। লোকের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে।’

বাজেট প্রণয়নে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, জনসাধারণকে স্বস্তি দিতে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে করভার কমানো হচ্ছে। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং বাণিজ্য সহজীকরণ ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষার উদ্যোগও থাকছে। বাজেট প্রণয়নে যুক্ত একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে শুল্ককাঠামো পুনর্মূল্যায়নের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি পর্যায়ে শুল্ক অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

চাপ বাড়ছে যেসব জায়গায়

বর্তমানে ৩১টি শিল্প খাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে। এসব শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, আসবাবপত্র, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, মোবাইল ফোন, খেলনা ইত্যাদি।

ফ্রিজ, এসি এবং বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত কৃত্রিম তন্তু পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবারের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন উৎপাদনে হ্রাসকৃত ভ্যাটের হার বাড়ানো হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, এতে ইলেকট্রনিকস শিল্পের সুরক্ষা কমবে, বিদেশি ইলেকট্রনিকসের সামগ্রী আমদানি বাড়বে। পাশাপাশি ক্রেতার খরচ বাড়বে।

গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত সিমেন্ট শিট উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে ভ্যাটের হার বাড়ানো হচ্ছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স (গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি) উৎপাদনে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, ইলেকট্রিক কেটলি, ইস্ত্রি, রাইস কুকার, মাল্টিকুকার ও প্রেশারকুকার উৎপাদনে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৫ শতাংশ, ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে।

দেশীয় টেক্সটাইল মিলের সুতা উৎপাদনে ভ্যাটের হার বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যান মেইড ফাইবার সুতার সুনির্দিষ্ট কর (ভ্যাট) ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হচ্ছে। শিল্পের লাভ-লোকসান যা-ই হোক, টার্নওভার কর দ্বিগুণ হচ্ছে। তবে টার্নওভারের সীমা ১ কোটি বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হচ্ছে।

ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিশেষ করে রাজধানীর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে স্থাপনা ভাড়া নিতে হয়। এ ভাড়ার উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করতে কনভেনশন হল ইত্যাদি ভাড়ার উৎসে কর দ্বিগুণ করে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতেও ব্যবসার খরচ বাড়বে।

লিফটের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে বছরভিত্তিক ভ্যাটের হার বাড়ানো হচ্ছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রির ওপর বর্তমানের ৫ শতাংশ ভ্যাট ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর সম্পূরক শুল্ক বসানো হচ্ছে।

বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার বিষয়টি কিছুটা স্বস্তির হলেও এর সঙ্গে করহারও বাড়ানো হচ্ছে। ৩ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে আয় থাকলে করদাতাদের বছরে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। বাংলাদেশে এই শ্রেণির করদাতা বেশি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রস্তাবিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির ফলে শিল্প খাতে চাপ বাড়বে। এর প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে। তবে দীর্ঘদিন ধরে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া শিল্প খাতগুলোর ওপর সেই সুবিধা সীমিত করার চাপও রয়েছে। এ জন্য ব্যবসা পরিচালনার খরচ কমানো এবং লজিস্টিকস খাতের উন্নয়ন করতে হবে।’

যেসব ক্ষেত্রে সুবিধা মিলবে

পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম আমদানিতে শুল্ক-করের হার হ্রাস করা এবং এসব পণ্যের ট্যারিফ মূল্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধসহ সব ধরনের ওষুধশিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতির সুবিধা রাখা হচ্ছে।

কৃষি খাতের মধ্যে হিমাগার স্থাপনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রদান ও স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে কম্বাইন হারভেস্টার তৈরির যন্ত্রাংশ ও ফ্রুটব্যাগ আমদানিতে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। কীটনাশক উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালে সব শুল্ক-কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে।

দেশে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে রেফারেল হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি ৫০ শয্যার বেশি হাসপাতাল স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক-কর হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সরকারের ওপর রাজস্ব আয় বৃদ্ধির চাপ রয়েছে। সে জন্য প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সরেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। তা ছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল হিসেবেও ধীরে ধীরে করছাড় তুলে নিতে হবে। তবে এর সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত