পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের নামে রাখা টাকা জমা হয় একটি একক অ্যাকাউন্টে। এটি সিসিএ বা সমন্বিত গ্রাহক হিসাব নামে পরিচিত। সেই টাকায় ব্যাংক থেকে যে সুদ আসে, এত দিন তা ছিল একরকম বিতর্কিত সম্পদ। বিনিয়োগকারীদের সেই টাকায় অধিকার থাকলেও সুদের ওপর তাদের ছিল না সরাসরি মালিকানা। আবার ব্রোকাররাও এই টাকাকে পুরোপুরি নিজেদের আয় বলতে পারত না।
বছরের পর বছর ধরে এই সুদের টাকা গেছে ব্রোকারদের ঘরে। কর দেওয়া হয়েছে; আয় হিসেবেও দেখানো হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবার সেই ধারাবাহিকতায় হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে। বিএসইসির পর্যবেক্ষণ, এই নিয়মে আর চলতে দেওয়া যায় না। এ লক্ষ্যে এ-সংক্রান্ত আইনের সংস্কার আনা হচ্ছে। বিএসইসির প্রাথমিক খসড়া আইনের ভাবার্থ দাঁড়াচ্ছে, ‘সিসিএর মুনাফা কারও নয়।’ অর্থাৎ না বিনিয়োগকারী, না ব্রোকারদের। তাই বলে সিসিএর মুনাফা পড়েও থাকবে না। তবে সেই টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কারা এটি ভোগ করবে; সেটি আইনের খসড়ায় স্পষ্ট করা হয়েছে। যেখানে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, সিসিএর মুনাফা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবে বিএসইসি।
এ-সংক্রান্ত খসড়া নিয়মে বলা হয়েছে, এই সুদ ব্রোকারদের ব্যক্তিগত আয় নয়। এর ২৫ শতাংশ যাবে স্টক এক্সচেঞ্জের ইনভেস্টরস প্রটেকশন ফান্ডে এবং বাকি ৭৫ শতাংশ খরচ হবে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা ও সচেতনতার কাজে। কেউ যেন এটিকে নিজেদের সম্পদ দাবি করতে না পারে, সে জন্য এ সিদ্ধান্ত। তবে এ নতুন সিদ্ধান্ত আরও কিছু বিতর্ক তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই টাকার মূল উৎস বিনিয়োগকারীদের মূলধন। তাই বিনিয়োগকারীদের অনুমতি ছাড়া এই অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন উঠছে। অনেকে বলছেন, শিক্ষার নামে এই অর্থ ব্যয় হলেও তার হিসাব কোথায়? কতটুকু কাজে লাগছে? কে দেখবে?
ব্রোকাররা এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই টাকায় কর দেওয়া হয়। তাহলে সেটি আয় নয়—এ কথা বলা আইনগতভাবে অসংগত।’
বিএসইসি বলছে, চাইলে ব্রোকাররা শুরু থেকে বিনিয়োগকারীদের অনুপাতে এই মুনাফা ফেরত দিতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি, বরং এই টাকা গিয়েছিল ব্রোকারদের অঘোষিত আয়ের খাতে। তাই এবার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সরাসরি ব্যবহারের নির্দেশনা দিচ্ছে।
এখানে উঠছে আরও কিছু প্রশ্ন, যেমন বিনিয়োগ শিক্ষা প্রকল্পের কার্যকারিতা কতটুকু? আগে যেসব প্রকল্প হয়েছে, তার প্রভাব কতটা? এবার যে টাকা খরচ হবে, তা কোথায় যাবে? কে তদারক করবে? বিএসইসির খসড়া এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি এক ধরনের সম্পদ স্থানান্তর। বিনিয়োগকারীদের আয়ের অংশ সরিয়ে একটি নতুন খাতে খরচ করা হচ্ছে, যার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, বাজার যখন আস্থার সংকটে, তখন এমন সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমাতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ সিদ্ধান্ত ব্রোকারদের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ, সিসিএর সুদ থেকে তারা একটি নিয়মিত আয় পেত। সেটি বন্ধ হলে তাদের আয় কমবে। যার ফলে তারল্যের সংকট হতে পারে এবং প্রযুক্তি খাতে ব্যয় কমতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রকের খসড়া যেমন নিয়ন্ত্রণ আনছে, তেমনি তৈরি করছে অনিশ্চয়তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে জনমত চাওয়া হয়েছে। যে কেউ এ বিষয়ে পরামর্শ বা আপত্তি জানাতে পারবেন ১২ মে পর্যন্ত।
এখন দেখার বিষয়, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষার কথা বলে যে টাকা অন্য খাতে নেওয়া হচ্ছে, তা আদৌ তাঁদের উপকারে আসে কি না; নাকি এটি হয় এক ধরনের অর্থ হস্তান্তর, যার পেছনে থাকে না কোনো জবাবদিহি বা স্বচ্ছতা।