Homeঅর্থনীতিভাঙনের মুখে মানুষের স্বপ্ন

ভাঙনের মুখে মানুষের স্বপ্ন


বাংলাদেশের আরও ৩০ লাখ মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে দারিদ্র্যের অন্ধকার। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, চলতি অর্থবছরেই এই বিপর্যয় সামনে আসছে। একসময় যে মানুষগুলো অল্প আয়ের ভেতরেও বুকভরা আশা নিয়ে দিন কাটাত, আজ তারা রুটি-রুজির টানাপোড়েনে নুয়ে পড়ছে।

এই সংকট হঠাৎ করে আসেনি। বছরের পর বছর অনিয়ম, সীমাহীন দুর্নীতি আর দুর্বল নীতির ছায়ায় বেড়ে উঠেছে আজকের অসহায়তা। গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের খাত থেকে ব্যাংকিং পর্যন্ত, লোপাটের গল্প ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি সেক্টরে। বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে নির্বিকারভাবে। আর এসব কাণ্ডের বোঝা এখন বইতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে; যারা দুদিন কাজ না করলেই খাদ্যের নিরাপত্তা হারায়, মাথার ওপর ছাদ হারানোর ভয়ে কাঁপে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতির হিংস্র ছোবল আর কাজের বাজারে ধস মিলিয়ে অতি দরিদ্রের সংখ্যা ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে যাবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে। দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ছুটে যাবে ২২ দশমিক ৯ শতাংশে। বিশ্লেষকদের মতে, সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়; এগুলো অসংখ্য মায়ের কান্না, বাবার মাথানত, শিশুর অনাহার হয়ে ধরা দিচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনই যদি সাহসী পথে হাঁটা না হয়, সামনে অপেক্ষা করছে আরও বড় বিপর্যয়। তাঁরা পাঁচটি মূল পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন। প্রথমত, উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে; বিশেষত খাদ্যের দাম যেন গরিবের নাগালে থাকে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পুনরুদ্ধারের প্রকল্প নিতে হবে, যেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে। তৃতীয়ত, সরকারের খরচের লাগাম টেনে ধরতে হবে, বন্ধ করতে হবে বিলাসী ব্যয় আর অকারণ অপচয়। চতুর্থত, বিনিয়োগের পথ খুলে দিতে হবে উদ্যোক্তাদের জন্য। এবং পঞ্চমত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হতে হবে আরও বড়, আরও শক্তিশালী; যাতে দারিদ্র্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো বাঁচার সুযোগ পায়।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি যদি কমানো না যায়, তাহলে মজুরি বাড়াতে হবে। তিনি আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় বড় বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। আর সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সতর্ক করেন—দারিদ্র্য নিরসনের অবস্থা এখন এতটাই নাজুক যে সরকার যদি বিনিয়োগ, কৃষকের ন্যায্যমূল্য এবং সামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার না দেয়, তবে ভবিষ্যতের চিত্র হবে আরও ভয়াবহ।

সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের কণ্ঠেও ছিল একই আশঙ্কা। তিনি বললেন, ‘সরকারকে টাইটানিক স্কেলের মাপের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ মুদ্রাস্ফীতি কমাতে বাজারে টাকার জোগান কমাতে হবে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বাজারে আস্থা ফেরাতে হবে।

পোশাকশিল্পের নেতা ফজলে শামীম এহসান সরাসরি বললেন, ‘শ্রমবাজারের স্থিতি ফেরাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, ভুল নীতি আর চলবে না।’ তিনি মনে করিয়ে দিলেন, উৎপাদনে গ্যাস ও বিদ্যুতের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে। একদিকে ভেঙে পড়া স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে কঠিন সিদ্ধান্তের অনিবার্যতা। এই মুহূর্তে আর অজুহাতের জায়গা নেই। যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁদের বুঝতে হবে—এটি শুধু অর্থনীতির সংকট নয়, এটি মানুষের জীবন-মরণ প্রশ্ন। প্রত্যেক অনাহারী শিশুর মুখ, প্রত্যেক আশাভাঙা পরিবারের কান্না যেন আজ একটাই প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে—কতদিন আর শুধু প্রতিশ্রুতিতে জীবন চলবে?





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত