গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ এমন ব্যাংকবহির্ভূত ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে (এনবিএফআই) চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সনদ (লাইসেন্স) বাতিলের সম্ভাবনা মাথায় রেখে কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না— তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চিঠিতে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্তমান আর্থিক অবস্থার ব্যাখ্যা ও ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মপরিকল্পনাও চাওয়া হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ থেকে সম্প্রতি এ চিঠি পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ২০টি এনবিএফআইকে চিঠি দেওয়া হয়েছে তাদের সার্বিক পারফরম্যান্স উন্নয়নের আহ্বান জানিয়ে। মূলত, এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে—সেই পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়েছে।’
তিনি জানান, সংকটে থাকা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমানত পরিশোধে সম্পদের ঘাটতি, শ্রেণিকৃত ঋণের উচ্চ হার, মূলধন ঘাটতি ও ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার মতো বিভিন্ন অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে।
এছাড়া, চিঠিতে আইনি বিধান অনুসারে উল্লেখ করা হয়েছে— কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়েছে। তবে এটিকে লাইসেন্স বাতিলের চূড়ান্ত পদক্ষেপ না বলে, বরং একটি সতর্কতা ও আত্মমূল্যায়নের সুযোগ হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, হয়তো চিঠি পাওয়া এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান সত্যি সত্যি ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা তাদের পরিকল্পনা জানার অপেক্ষায় আছি। তাদের চিঠির ব্যাখ্যা পাওয়ার পর হয়তো কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও সুযোগ দেওয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এক পর্যালোচনায় গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ হারে শ্রেণিকৃত ঋণ, মূলধন ঘাটতি এবং সম্পদের অপর্যাপ্ততা বিবেচনায় ২০টি এনবিএফআইকে সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ঋণই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এবং জামানতের পরিমাণও অপ্রতুল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী, দেশে মোট এনবিএফআই রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২০টির অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা এবং ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যার ৮৩ শতাংশই খেলাপি। এসব প্রতিষ্ঠানের ক্রম পুঞ্জিত ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকায়।
তালিকাভুক্ত ২০টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে—সিভিসি ফাইন্যান্স, বে-লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, হজ্জ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স।
চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আলমগীর বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পেয়েছি। আলোচনা করে কর্মপরিকল্পনা জমা দেবো। ঋণ আদায় করে গ্রাহকের টাকা ফেরতের চেষ্টা করছি।’
এদিকে, এসব দুর্বল প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো খাতেই আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের মতে, ভালো অবস্থানে থাকা এনবিএফআইগুলোর ব্যবসাও এতে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কার, তদারকি এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।
এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে— সংকটাপন্ন এনবিএফআইগুলোর প্রকৃত কোনও সুদ আয় নেই। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বার্ষিক ব্যয় প্রায় ২০৬ কোটি টাকা। ফলে পুনর্গঠন বা একীভূত করার বিকল্প নেই।
একীভূত হলে ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে কীভাবে?
নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) লাইসেন্স বাতিল বা একীভূত হলে ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের অর্থ কীভাবে ফেরত দেওয়া হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘যদি কোনও এনবিএফআই বন্ধ হয়ে যায়, তবে আইন অনুযায়ী ক্ষুদ্র আমানতকারীরা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন, যা ব্যাংক বন্ধের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নিয়ম।’
তবে বড় অঙ্কের আমানতের ক্ষেত্রে অর্থ ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নির্ধারণ করবে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জারি করা এক অধ্যাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংককে যেকোনও তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ার হস্তান্তরের আদেশও দিতে পারবে, তবে সেটি সরকারি মালিকানাধীন কোনও কোম্পানির কাছেই হতে হবে।
এ লক্ষ্যে ৯ মে প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর সংশোধিত গেজেট, যা ১৭ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পেয়েছিল।
আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান গভর্নরের
এনবিএফআইয়ের পাশাপাশি দুর্বল ছয়টি বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনাও এগোচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকার অস্থায়ীভাবে এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, যা একীভূতকরণের পূর্ব প্রস্তুতির অংশ। এতে আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, বরং তারা আরও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অংশ হবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমানতকারীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি—যেন তারা আতঙ্কিত হয়ে টাকা উত্তোলনের পথে না যান। সরকার যেহেতু এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, তাদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। সব মিলিয়ে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের এই উদ্যোগ—চরম সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন ও স্থিতিশীল করার জন্য, যাতে আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়।’