আগামীকাল বুধবার (২১ মে) স্পেনের বিলবাওতে ইউরোপা লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে দুই ইংলিশ জায়ান্ট—ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহ্যাম হটস্পার। তবে ফুটবল রোমাঞ্চের চেয়ে বিতর্ক যেন বেশি উসকে দিচ্ছে এই ম্যাচ!
দুই দলই এবারের প্রিমিয়ার লিগে ভীষণ খারাপ সময় পার করছে। ইউনাইটেড লিগ টেবিলের ১৬তম, আর টটেনহ্যাম ১৭তম স্থানে। এমন দুই দল যখন ইউরোপা লিগের শিরোপার লড়াইয়ে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—এই দলগুলোর কি আদৌ পরবর্তী মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার অধিকার আছে?
ইউরোপার মর্যাদার মৃত্যু?
আর্সেনালের সাবেক ম্যানেজার ও ফরাসি কিংবদন্তি আর্সেন ওয়েঙ্গার সোজাসাপটা বলেই দিয়েছেন—‘ইউরোপা লিগের বিজয়ীকে চ্যাম্পিয়নস লিগে না তুলে, পরের ইউরোপা আসরে সুযোগ দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। বিশেষ করে যখন প্রিমিয়ার লিগ থেকে এমনিতেই পাঁচটি দল সুযোগ পাচ্ছে।’
তার এই মন্তব্যে সায় দিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দুই কিংবদন্তি ফুটবলার গ্যারি নেভিল ও রয় কীন। নেভিল বলেন,
‘এখন আর কেউ ট্রফি জয়ের জন্য খেলে না। সবাই টাকার কথা ভাবে। ইউরোপা লিগ জয় এখন £৬০ মিলিয়নের ম্যাচ। এটাই সবকিছু।’
‘স্পার্স বললেই লোকজন ক্ষেপে যায়!’
তবে বিতর্কের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ কৌতুকে পরিস্থিতিকে উল্টো হালকা করে দিয়েছেন টটেনহ্যামের কোচ আঞ্জে পোস্টেকগ্লু।
‘এই নিয়ম তো ২০১৫-১৬ মৌসুম থেকেই চলছে। তখন কেউ প্রশ্ন তোলে না। এখন হঠাৎ স্পার্স ফাইনালে, আর সবাই তেতে গেছে! স্পার্স নামটা শুনলেই মানুষ অস্থির হয়ে যায়, এটাই বাস্তবতা।’
ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মৌসুম?
সমালোচনার কারণও অবশ্য স্পষ্ট। টটেনহ্যাম এবার সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ক্লাব ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৫টি ম্যাচ হেরেছে। টানা ১২ ম্যাচে প্রিমিয়ার লিগে গোল খেয়েছে তারা—১৫ বছরে এমন হয়নি।
অন্যদিকে, ইউনাইটেড টানা ৮ ম্যাচ জয়বিহীন, যা ১৯৯০ সালের পর প্রথমবার। তারা এরইমধ্যে ১৮টি ম্যাচ হেরেছে—১৯৭৩-৭৪ সালের অবনমনের মৌসুম ছাড়া এমনটা হয়নি।
তবুও ফাইনালে কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন স্বয়ং পোস্টেকগ্লু, ‘আমরা জানি লিগে ভালো করিনি। কিন্তু তাতে কি ফাইনালে ওঠার অর্জন ছোট হয়ে যায়? আমরা এই জায়গা অর্জন করে নিয়েছি। কে কোন অবস্থানে আছে, সেটা আমার কিছু আসে যায় না।’
আর বাস্তবতা হচ্ছে—ইউনাইটেড ৭-১ গোলে অ্যাথলেটিক ক্লাবকে হারিয়ে ফাইনালে এসেছে। টটেনহ্যাম জিতেছে বুন্দেসলিগায় তৃতীয় হওয়া আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের মাঠে। তাই এই অর্জন দুটোকেও খাঁটো করে দেখার কিছু নেই।
চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট ‘পুরস্কার’, প্রাপ্যতা নয়?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপা লিগ এখন এমন এক পর্যায়ে যেখানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা পাওয়াটাই মূল আকর্ষণ। ওয়েঙ্গার নিজেও স্বীকার করেছেন— ‘প্রতিযোগিতাটির আকর্ষণ ধরে রাখতে হলে বড় প্রণোদনা দিতে হয়। আর সেটিই হচ্ছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের টিকিট।’
কিন্তু এও প্রশ্ন থেকে যায়—এই সিস্টেম কি ইউরোপিয়ান ফুটবলের বৈষম্যকেই আরও বাড়াচ্ছে না?
সুপার লিগের ছায়া?
ইউরোপা লিগ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে যাওয়ার রাস্তাকে অনেকে বলছেন ইউরোপিয়ান সুপার লিগ ধারণার একরকম কৌশলী বাস্তবায়ন। বড় দলগুলো যেন সবসময় বড় মঞ্চে থাকে—এটাই যেন লক্ষ্য।
রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ, যিনি সুপার লিগের অন্যতম রূপকার, নিশ্চয়ই হাসছেন। কারণ, ইংল্যান্ডের ১৬তম ও ১৭তম স্থানে থাকা ক্লাব যখন ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় জায়গা পায়, তখন স্পেন, ইতালির ক্লাবগুলো কেবল অসহায় চোখে চায়।
ইউনাইটেড-স্পার্স ফাইনাল নিঃসন্দেহে উত্তেজনার। কিন্তু এটা ইউরোপিয়ান ফুটবলের আরও গভীর এক সংকেতও বটে—যেখানে বড় লিগের অর্থবলে ‘দুর্বল’ দলও তুলনামূলক ছোট দেশগুলোর শীর্ষ ক্লাবের চেয়ে অনেক এগিয়ে। প্রশ্নটা এখন আর ম্যাচজয় নয়, বরং ফুটবলের ন্যায্য কাঠামো নিয়েই।