Homeজাতীয়আছে কিছু ক্ষোভ, সঙ্গে কিছু আশা

আছে কিছু ক্ষোভ, সঙ্গে কিছু আশা

[ad_1]

আমাদের আত্মত্যাগের কারণে এই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, আমরা নতুন একটা বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা কি তাহলে অবহেলা ডিজার্ব করি? অনেকের প্রাণ চলে গেছে, আমাদের কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা, আবার কেউ চোখ। আমাদের প্রতি উদাসীনতা কেন? সরকারপ্রধান-উপদেষ্টারা- কি পারেন না একবার এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে? – এভাবেই নিজের আক্ষেপের কথা জানাচ্ছিলেন জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একাধিক গুলি খেয়ে আহত নাদিম হাওলাদার। এমন আক্ষেপের মাঝেও কিছু আশা বুকে বেঁধে আছেন তিনি, হয়তো তাদের প্রতি উদাসীনতা দূর হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এখন পর্যন্ত নিহত ৮৭৫ জনের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। আহতের সংখ্যা ৬ হাজার ১৬৭ জন। তালিকা হালনাগাদের কাজ এখনও চলমান রয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আন্দোলনে আহতরা বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এরমধ্যে ৮৫ জন চিকিৎসাধীন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ এর বেশি আহত রোগী সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে হাত-পা কাটা গেছে ২১ জনের, যার মধ্যে ১৭ জনের পা এবং চার জনের হাত কাটা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে আহত মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। সেখানে কয়েকজন আহতের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। আন্দোলনের ট্রমায় এখনও ভুগছেন অনেকে। জুলাইয়ের স্মৃতি ভুলে যেতে চান তারা। মনে করলেই তাদের শরীর কেঁপে ওঠে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত নাদিম হাওলাদার পরিবারসহ থাকতেন রাজধানীর চিটাগাং রোডের পাশে, কাচপুর ব্রিজের কাছে। আন্দোলনের মধ্যে গত ২০ জুলাই নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে আহত হন নাদিম। নিম্ন আয়ের পরিবারে বেড়ে ওঠা ২০ বছর বয়সী নাদিম সংসারে হাল ধরার চেষ্টা করছিলেন। আয় রোজগারের কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি। গত ১৭ জুলাই কাজ ছেড়ে আন্দোলনে যুক্ত হন।

বাংলা ট্রিবিউনকে নাদিম বলেন, ‘প্রতিদিন কাজে যাওয়া-আসার সময় আন্দোলন দেখতাম। ফোনে ভিডিও, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া দেখতাম। একদিন আর সহ্য হলো না, আমিও যাওয়া শুরু করলাম ১৭ জুলাই। ২০ জুলাই বিকালে প্লেনের জন্য ব্যবহার করা তেলের ট্যাংকার চিটাগাং রোড দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা আটকে দেই। রাস্তায় আগুন ধরিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেই। হঠাৎ কোত্থেকে জানি নিরাপত্তা বাহিনী এলো। কথা নাই, বার্তা নাই, উল্টা-পাল্টা গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আমি যদি বুক পেতে দিতাম তাহলে আমার মা আমার লাশটাও দেখতে পাইতো না। মেইন রোড থেকে গুলি করতে করতে তারা গলির ভিতরে ঢুকে পড়ে। আমিও তখন গলিতে ছিলাম।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা তিনি বলেন, ‘হঠাৎ দেখি আমার বাম হাত ঝুলতেসে। ছোট বেলায় একবার হাত ভেঙে গেসিলো, তাই ভাবছিলাম প্লাস্টার করলে ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখি হাত থেকে গরুর জবাই করলে যেভাবে রক্ত বাইর হয়, সেভাবে রক্ত পড়তেসে। আমি বারবার রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিলাম, সহকর্মীরা ধরে আমাকে এলাকার একটা ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। দোকানের লোক আমার অবস্থা দেখে শাটার বন্ধ করে দেয়। এরপর আমার ভাই আমাকে ধরে সাইনবোর্ড এলাকার একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে যেতে বলে। আমার বাম হাতে কনুইয়ের নিচে একটা, ওপরে দুইটা এবং বুকের পাশে বগল বরাবর একটাসহ মোট ৪টা গুলি লাগে। কনুইয়ের নিচে গুলিটা কয়েকটা রগ নিয়ে মাংসসহ আলাদা হয়ে পড়ে যায়। কনুইয়ের ওপরের গুলিটা হাড় ভেঙে বের হয়ে যায়। বগলের পাশে যে গুলিটা লেগেছে, সেটা বের হয়ে যায়।’

নাদিম বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য অনেক জায়গায় কয়েকবার আমাকে শরণাপন্ন হতে হয়েছে। প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল, সেখান থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে আবারও ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয় হাতের রগের ট্রিটমেন্টের পর। কিন্তু একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে, গুলিবিদ্ধ আহতদের খুঁজে বের করা হচ্ছে মামলা দেওয়ার জন্য। তখন আমার পরিবার আমাকে বাসায় নিয়ে যায়। গত মাসের ২২ তারিখ পুনরায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হই। এখানে আমার ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা চলে। কয়েকদিন আগে অপারেশন করতে গিয়ে হাতের রগ কেটে গিয়েছিল। সেটার জন্য আমাকে আবারও হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।’

আক্ষেপের সুরে এই তরুণ বলেন, ‘স্বাস্থ্য উপদেষ্টা যেদিন পঙ্গুতে আসেন তখন আমি হৃদরোগ হাসপাতালেই ছিলাম। গতকাল (শনিবার) এখানে আসছি। সেদিন গণ্ডগোল হইসে, উনি আসছেন সবার সঙ্গে দেখা করুক, আমাদের সব ভাইকে দেখুক, আমাদের জন্যই তো আজ ওনারা এখনকার অবস্থানে আছেন। তিনি যদি এসে চারতলায় চার জনকে দেখে চলে যান, তাহলে এখানে যারা আছে তারা কি গুলি খায় নাই? এরা কি দেশের জন্য লড়াই করে নাই? সমন্বয়করাও তো দূরে দূরে, যেন আমরা তাদের কাছে অনেকটা অচেনা। প্রথমদিকে একদিন এসে খোঁজ নিয়ে গেছে, কিছু টাকা দিয়ে গেছে, আর কোনও খবর নাই। মনে হয় যেন ভিক্ষা দিয়ে চলে গেলো। সবচেয়ে বড় দুঃখ সরকারপ্রধান, যাকে আমরা বানালাম, তিনি একদিন সময় করতে পারলেন না আমাদের জন্য। সরকার অনুদান দেবে, সেটারও খোঁজ নাই। একদিন খোঁজ নিলাম, ফোন ধরে না, ফোন ধরলে বলে টাকা নাই, এখনও আসে নাই। টাকার জন্য তো আর আমরা লড়াই করি নাই। তাই আর ফোন দেই নাই। তিন দিনের মধ্যে দেবে বলছে সরকার, দেখি দেয় কিনা!’      

নাদিমের পাশের বেডেই শুয়ে ছিলেন আন্দোলনে আহত মো. রাকিবুল ইসলাম। আন্দোলনের স্মৃতি মনে করে তিনি জানান, কাজে না গিয়ে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সাভার এলাকার পাকিজা বাস স্ট্যান্ডের কাছেই একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে যোগ দেন। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন গিয়ে যুক্ত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খাওয়া দুই গাড়ির মধ্যবর্তী স্থানে চাপা পড়েন তিনি।

রাকিবুল বলেন, ‘সাভার ডেইরি গেটের সামনে দুপুর দেড়টার দিকে দুই গাড়ির মাঝখানে পড়ে চাপা খাই আমি, রাস্তার সাইডে গিয়ে পড়ি। তখন শিক্ষার্থীরা ধরে আমাকে জাহাঙ্গীরনগরের মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে খুব কষ্টে বাসায় ফিরি।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি পায়ের চিকিৎসার জন্য মিরপুর পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র বা সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) সেন্টারে ভর্তি ছিলাম। সেখানে একটা অপারেশন করা হলো। কিন্তু হাঁটুতে যে সমস্যা সেটি ঠিক করা সম্ভব না বলে তারা আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করে দেয়। দুঃখের বিষয়, এখানে আবার প্রথম থেকে চিকিৎসা শুরু করলো। তারা সিআরপি’র ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা এগিয়ে নিতে পারতো, কিন্তু এখানে সেই ধীর গতি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার থেকে আশ্বাস দিয়েছে সহায়তা দেবে। সেজন্য আমার তথ্য বিভিন্ন জায়গায় ভেরিফাই করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের মেডিক্যাল থেকে শুরু করে আমার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত তথ্য যাচাই করা হয়েছে। অনেকেই সহায়তা পেয়েছে, আসলে এখানে অনেক ভেরিফিকেশনের বিষয় আছে, তাই হয়তো একটু সময় লাগছে। যারা আন্দোলনে আহত হয়েছে, তাদের তো সরকার অবশ্যই ভেরিফাই করে দেবে।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. হাসান বলেন, ‘আমাদের সামান্য চিকিৎসা দিয়ে মাসের পর মাস এখানে রাখা হয়েছে। আমার পায়ে ৯টি অপারেশন করা হয়েছে, তারপরও এখন পর্যন্ত সুস্থ হতে পারিনি। আমাদের অপারেশনে শুধু নিয়ে যায়। আমাদের সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসেনি, কথাও বলেনি। আমরা চাই— সরকারের লোকজন আমাদের কাছে আসুক, আমাদের কথাগুলো শুনুক।’     

গত বুধবার (১৩ নভেম্বর) পঙ্গু হাসপাতালের সামনে সুচিকিৎসার দাবিতে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা। এদিন হাসপাতালে রোগীদের পরিদর্শনে আসেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। এ সময় হাসপাতালে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে অল্প কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান তারা। তখন আহতরা হাসপাতাল থেকে নেমে তাদের পথ অবরুদ্ধ করে রাখেন। গভীর রাত পর্যন্ত তারা সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেন। পরে গভীর রাতে সরকারের চার উপদেষ্টা এবং একজন বিশেষ সহকারী সেখানে যান।

উপদেষ্টারা ভুল স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশ করেন। তারা আহত ব্যক্তিদের দাবি -দাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় সচিবালয়ে বৈঠকে বসে কথা বলেন। সচিবালয়য়ে বৈঠকের পর স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন এবং বিভিন্ন অংশীদারদের সমন্বয়ে গণঅভ্যুত্থানে আহতদের আমৃত্যু চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা বলতে চাই— আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যাপারে গাফিলতি সহ্য করা হবে না। আহতদের চিকিৎসাসেবা, সেবা প্রাপ্তি অর্থলাভসহ সবক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে।’



[ad_2]

Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত