বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই পুলিশকে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে প্রস্তাব দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। এ জন্য তাঁরা দ্রুত স্বাধীন কমিশন গঠনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জোর দাবি জানান।
পুলিশ সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ‘স্বাধীন কমিশন’ গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়ায় ও আলোচনা না হওয়ায় অনেক কর্মকর্তা এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশ সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার কাছে ‘স্বাধীন কমিশন’ গঠনের জোর দাবি জানান তাঁরা। পুলিশ সপ্তাহের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পুলিশ সপ্তাহের প্রথম দিনের আয়োজনে পুলিশ সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানান। তার মধ্যে ‘স্বাধীন কমিশন’ গঠন ছিল অন্যতম।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বক্তব্য দেন। তারপর দুজন পুলিশ সদস্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের দাবি বা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁরা বিশেষ ভাতা ও স্বাধীন কমিশনের দাবি করেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা জেলার নারী পুলিশ কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা প্রধান উপদেষ্টার কাছে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ বাড়তি ভাতা দাবি করেন। তিনি বলেন, সাপ্তাহিক, জাতীয় বিশেষ দিন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ বছরে প্রায় ১২৯ দিনের বেশি ছুটি থাকে। সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তারা এসব ছুটি ভোগ করলেও পুলিশ এসব ছুটি পায় না। এসব দিনে আরও বাড়তি ডিউটি করতে হয়। এ ছাড়া পুলিশের কোনো কর্মঘণ্টা নির্ধারণ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরা বাড়তি কোনো ভাতা পান না। তাই সকল পুলিশ সদস্যকে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ ভাতা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এরপরই পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানান পুলিশ সদর দপ্তরের এএসপি মো. আল আসাদ। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু পুলিশ সংস্কার কমিশনে বিষয়টি সেভাবে আসেনি। স্বাধীন কমিশন গঠনের বিষয়ে তাঁরা আরও বিশদ আলোচনার কথা বলেছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও স্বাধীন কমিশন নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে পুলিশকে স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত একটি পরিচ্ছন্ন বাহিনী করতে হলে এখনই স্বাধীন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের দাবি মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং এই দাবি যৌক্তিক বলে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন। প্রতিটি দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্য শেষে মঞ্চ থেকে নেমে বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির স্টল উদ্বোধন ও পরিদর্শন করে রাজারবাগ থেকে বিদায় নেন। তিনি ৪৫ মিনিট রাজারবাগে ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা চলে যাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পুলিশের বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা সমস্যা, সংকট, ক্ষোভ ও কষ্টের কথা বলেন।
মতবিনিময় সভায় র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান পুলিশ ক্যাডার বা এএসপি পদে অবিবাহিতদের নিয়োগের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ হওয়ার আগেই প্রার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শারীরিক উচ্চতা, ফিটনেস এগুলো দেখা উচিত। তাঁরা পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়ার পর এসব কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হয়।
মতবিনিময় সভায় আরও কথা বলেন বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল (ভারপ্রাপ্ত) ব্যারিস্টার মো. জিল্লুর রহমান। তিনি আবাসন, গাড়ির সংকট নিয়ে কথা বলেন।
এ ছাড়া কিছু অর্থঋণ আদালত বন্ধ রয়েছে। এ কারণে পুলিশের কাজ করতে সমস্যা হয় বলেও পুলিশ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সমাধানের প্রস্তাব দেন।
খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) মো. জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। যাতে সেবা বাড়ানো যায়।
একজন সার্জেন্ট ট্রাফিক পুলিশের ভাতা চালুর প্রস্তাব করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও থানা পরিদর্শন করি। পরিদর্শনকালে পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা আমার নজরে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হচ্ছে অধস্তন ফোর্সদের থাকা ও খাওয়ার সমস্যা।’ তিনি বলেন, পুলিশের যানবাহন সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। থানার জন্য ২০০টি পিকআপ ভ্যান ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে, যা আজ ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উঠবে। এসবসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ব্যাপকভাবে জনবল বৃদ্ধি, গ্রাম পুলিশকে থানার অধীন করা, সার্কেল অফিসে বাজেট প্রদান ও নারী পুলিশের জন্য টয়লেট ও চেঞ্জ রুমের ব্যবস্থা করার দাবি জানান পুলিশ সদস্যরা।
এরপর বিকেলে পুলিশ সপ্তাহের প্রথম দিনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। গত ১৭ মার্চ বাংলাদেশ পুলিশের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর কার্যালয়ে ৩৯ মিনিট দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। বক্তব্যে ২১ দফা নির্দেশনা ছিল। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৯৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য ২১টি দলে বিভক্ত হয়ে অংশ নেন। এতে ৩টি প্রতিপাদ্য এবং ৬টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিপাদ্য ৩ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনকল্যাণে শৃঙ্খলা, অংশীদারত্ব ও দায়িত্বশীল পুলিশি ব্যবস্থা; ইতিবাচক মনোভাব ও জনবান্ধব আচরণের মাধ্যমে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে পুলিশের ভূমিকা।
কর্মশালায় নির্ধারিত ৬টি লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও কাজের পরিবেশ সৃষ্টি; পরাজিত শক্তির উসকানি, অপপ্রচার, শৃঙ্খলাভঙ্গ ও শান্তি বিনষ্টকারীদের অপচেষ্টা প্রতিরোধ; ‘পুলিশ খারাপ না’ দেখিয়ে দেওয়ার অন্ধকার যুগের চিন্তা এবং খারাপ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসা; সব নাগরিকের আশ্রয়দাতা হয়ে পুলিশের পজিটিভ ইমেজ তৈরি; সামনের নির্বাচনে পুলিশ কোনো রকম চাপ, শক্তি বা হস্তক্ষেপের কাছে মাথা নত না করে আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালন এবং নির্বাচন এগোনোর পাশাপাশি বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার তীব্রতর হওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে ফ্রন্ট ফোর্সসংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার শনাক্ত করে সত্য তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে।
এরপর এসবির একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়। পুলিশের এই বিশেষ শাখা তাদের কর্মপরিকল্পনার কথা জানায় প্রেজেন্টেশনে।
এর আগে সকালে ৬২ জন পুলিশ সদস্যকে বিপিএম-পিপিএম পদকে ভূষিত করা হয়।
এবারের পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে বাইরের কোনো অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। তবে উপস্থিত ছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা।