নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন। তিনি বলেন, ‘কমিশন হয়েছে, যারা অন্তর্বর্তী সরকার, তারাই কমিশন গঠন করেছে। এ রকম একটি কমিশনকে সরাসরি আক্রমণ করা হচ্ছে, কিন্তু এ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। তখন কিন্তু আশাবাদী থাকা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।’
আজ রোববার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে (কেআইবি) সংস্কার নিয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন গীতিআরা নাসরিন।
গীতিআরা নাসরিন বলেন, ‘নারী কমিশন রিপোর্ট দেওয়ার পর তাদের সরাসরি আক্রমণ করা হচ্ছে। ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু একটি কমিশন তৈরি হয়েছে। তারা একই পরিশ্রম করে সবার মতামত নিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার পর বলা হয় সেই কমিশন বাতিল করতে হবে। তখনই প্রশ্ন জাগে যে, আমরা স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করারও একটি পরিসর তৈরি করতে পারছি না।’
নাসরিন বলেন, ‘বিতর্ক থাকতেই পারে, প্রশ্ন উঠতেই পারে, সেটি যে কোনো কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে। কিন্তু অবহেলা করা হচ্ছে, আক্রমণ করা হচ্ছে এবং দুঃখজনক হলেও আমরা এখনো দেখিনি— যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা এটি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেছেন যে এটি করা যাবে না।’
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের এই সদস্য আরও বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক দলের কাছে স্পষ্ট করে শুনতে চাই, নারীদের ওপর যে বৈষম্য আছে, তারা এগুলোর বিষয়ে কী অবস্থান নেবে। পরিষ্কারভাবে তাদের ঘোষণা দিতে হবে। তাদের সঙ্গে আলোচনায় আসতে হবে। আমরা গণমাধ্যম থেকেই খবর পাই, এ-সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বলেছে ইমিডিয়েট কী করতে হবে। আমি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রশ্ন করতে চাই, গণমাধ্যম যে অবস্থায় আছে, তাতে নির্বাচনটা সুষ্ঠু করা সম্ভব কি না।’
রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা একটি অসাধারণ সময় ও সুযোগ পার করছেন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, প্রতিটি আন্দোলনে নারীরা সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছেন। এই ভূমিকার পর আন্দোলন শেষে তাঁরা আবার ঘরে ফেরত গেছেন গৃহস্থালির কাজে। কিন্তু এবারই দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মের নারীরা প্রবল আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে আসতে চাইছেন।
সামিনা লুৎফা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, নারীরা রাজনীতি আসতে চাইছেন, তাঁদের সে সুযোগটা করে দিতে হবে। এ কারণে তাঁরা দাবি করছেন, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আবার নির্বাচনপদ্ধতিতে নারীদের অংশগ্রহণে আগ্রহী করার প্রক্রিয়া থাকতে হবে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে সামিনা লুৎফা বলেন, কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। আলোচনাটা খুব জরুরি। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে এই আলোচনা চালু থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সামিনা লুৎফা বলেন, অতীতে দেখা গেছে, রাজনীতিতে বারবার স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা চলে আসে। এই প্রবণতা ঠেকানোর জন্য ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোয় বলা হয়েছে। নাগরিক হিসেবে তাঁর চাওয়া, কমিশন এই বিষয়গুলোর ওপর জোর দিক। যাঁরা সংসদে থাকবেন, যাঁরা নীতি নির্ধারণ করবেন, তাঁদের যেন একটা জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা যায়।
সংস্কারের অনেক বিষয়ে অনেকের মত-দ্বিমত থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেন সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, তবে একজন নাগরিক হিসেবে বেশ কিছু বিষয়ে তিনি নিশ্চয়তা চান। নাগরিকের অধিকার, কথা বলার অধিকার, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা ও প্রান্তিক মানুষের মৌলিক অধিকারের জায়গাগুলোয় সবাইকে একমত হতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল যদি এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, তাহলে ঐকমত্য কমিশন যেন বিষয়গুলো তাদের বোঝায়।