প্রচলন ক্রমে বেড়ে যাওয়ায় ই-সিগারেট বা এ ধরনের তামাকভিত্তিক পণ্যকেও তামাকজাত দ্রব্য হিসেবে গণ্য করে এসবের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে নতুন অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। অধ্যাদেশটি কার্যকর হলে ই-সিগারেট ব্যবহার করলে গুনতে হবে জরিমানা। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ভেপিংয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে স্বাস্থ্য খাতে কাজ করা ব্যক্তিদের উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে সরকারের এ উদ্যোগ এল।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) নামের নতুন এই অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, এর যন্ত্রাংশ বা অংশবিশেষ (ই-সিগারেট, ভেপ, ভেপিং, ভেপার ও ই-লিকুইড ইত্যাদি), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস বা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, তা উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন করা যাবে না। এই নিয়ম না মানলে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড, ২ লাখ টাকা জরিমানা হবে।
কোনো কোম্পানি আইন অমান্য করলে তাদের মালামাল জব্দসহ কোম্পানির মালিক, ব্যবস্থাপক বা দায়ী ব্যক্তিকে ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা হবে। কোনো ব্যক্তি ই-সিগারেট ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের যন্ত্রাংশ বা অংশবিশেষ ব্যবহার করতে পারবেন না। এসব ব্যবহার করলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টিদ্রব্য, মসলা, রং, সুগন্ধি, আসক্তিমূলক দ্রব্য বা মিশ্রণ যোগ করলে ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, ভেপিংয়ে ব্যবহৃত তরলে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধ যোগ করা হয়ে থাকে।
খসড়ায় তামাক ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে তামাকজাত পণ্যের মোড়কের গায়ের ৯০ শতাংশ জায়গাজুড়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কবাণী রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে মোড়কের ৫০ শতাংশ জায়গায় এই সতর্কবাণী দেওয়া হয়।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপনের জন্য তৈরি করা সার-সংক্ষেপে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ জানিয়েছে, দেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এ-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের-২০১৭ তথ্যমতে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।
ই-সিগারেট জাতীয় পণ্য ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট হিসেবেও পরিচিত। এর প্রচলিত জনপ্রিয় নাম ‘ভেপ’ (Vape)। ই-সিগারেট বা ভেপ পেন দিয়ে বাষ্প আকারে তামাক সেবনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ভেপিং। সাধারণ মানুষের অনেকের ধারণা, সরাসরি সিগারেটের তামাক পুড়িয়ে ধোঁয়া টানা হয় না বলে ই-সিগারেট বা ‘ভেপ’ ক্ষতিকর নয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধারণা ভুল।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ চিকিৎসাসেবা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জন্স হপকিন্স মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মাইকেল জোসেফ ব্লাহাকে উদ্ধৃত করে বলছে, ই-সিগারেট প্রচলিত তামাকের সিগারেটের চেয়ে কিছু কম ক্ষতিকর হলেও নিরাপদ নয়। এর উপাদানের মধ্যেও নিকোটিন রয়েছে। এটির আসক্তি সৃষ্টির ক্ষমতা প্রচলিত সিগারেটের মতোই।
মাইকেল ব্লাহার তথ্য অনুযায়ী, গবেষণায় দেখা গেছে, ভেপিং হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর।
বদলাচ্ছে নিয়ম, বাড়ছে সাজা
বর্তমান আইনে তামাকজাত দ্রব্যের সংজ্ঞায় ই-সিগারেট অন্তর্ভুক্ত নেই। নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, তামাক, তামাকপাতা বা এর নির্যাস থেকে প্রস্তুত করা যেকোনো দ্রব্য, যা চুষে বা চিবিয়ে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেওয়া যায় বা অন্য কোনোভাবে সেবন করা যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা, খৈনি, সাদাপাতা, সিগার (চুরুট), হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণ এবং ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (বিকাশমান তামাকজাত পণ্য)। যেমন ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদি নিকোটিন দ্রব্য, তা যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, অন্তর্ভুক্ত হবে।
বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস (উদ্যান, বাজার ইত্যাদি জনপরিসর) বা বাস, লঞ্চ, ট্রেনের মতো গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা রাখার কথা আছে। এটি বিলুপ্তির প্রস্তাব করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলেছে, জনপরিসর শ্রেণির স্থানের ভেতরে পৃথক ধূমপানের এলাকা থাকলে অধূমপায়ীরা তামাকের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পায় না। কারণ ধূমপান এলাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় বারবার দরজা খোলা হয় বলে ধোঁয়া আশপাশে ছড়িয়ে অধূমপায়ীদের ক্ষতি করে। এ বিষয়ে আপিল বিভাগ এক রায়ে ধূমপানমুক্ত স্থানে ধূমপানের জন্য ব্যবস্থা না রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে।
অধ্যাদেশে গণপরিবহন হিসেবে মোটরগাড়ি, বাস, রেল, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সব যানবাহন ও উড়োজাহাজের সঙ্গে অযান্ত্রিক যানকেও যুক্ত করা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রিকশা ও নৌকার মতো অযান্ত্রিক যানবাহনের যাত্রীরাও অন্যের ধূমপানের ফলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।
বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। অধ্যাদেশে এসব স্থানে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পানের (যা তামাক থেকে তৈরি জর্দা দিয়ে সেবন করা হয়) মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য সেবন করে পিক ও থুতু ফেলায় সংক্রমণ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের শাস্তি বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা জরিমানা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এখন সিনেমা হল, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর সঙ্গে ওয়েবপেজ এবং অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিজ্ঞাপন প্রচার-সংক্রান্ত বিধান না মানলে এখন তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড, ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যায়। এ অর্থদণ্ড বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে ফেরি করে বা ভ্রাম্যমাণ দোকানে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন ছাড়া তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করা যাবে না। এই বিধান অমান্য করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশুপার্কের সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অমান্য করার সাজা হবে ৫ হাজার টাকা জরিমানা।
দুবার মন্ত্রিসভা থেকে খসড়া ফেরত
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আগের আইন সংশোধন করে বেশ আগে নতুন খসড়া করেছিল সরকার। সে খসড়া পাসের জন্য ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হলেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তা প্রত্যাহার করে নেয়। পরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেও গত ২৭ অক্টোবর খসড়াটি প্রত্যাহার করা হয়। এরপর গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এটি পরিমার্জন করতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে ৯ উপদেষ্টাকে নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
ওই উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি এখনো তাদের সুপারিশ দেয়নি বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ খসড়াটি পরিমার্জন করবে। এরপর তা পাসের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হবে।
চিকিৎসকের অভিমত
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার যে হারে কমার কথা ছিল, সে হারে কমেনি। কারণ আইনে দুর্বলতা ছিল, তার প্রয়োগেও দুর্বলতা রয়েছে। ই-সিগারেট নেশাকারী দ্রব্য। কোন আইনে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা কোথাও বলা ছিল না। আইনে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো প্রয়োগ করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।’