বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আন্দোলন হয় ৩০ জুন। বাংলা বিভাগের শামসুর রহমান সুমন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গোলাম শাওন, ইংরেজি বিভাগের মো. শফিকুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন প্রথম উদ্যোগী হয়ে আন্দোলনের ডাক দেয়।
১৪ জুলাই শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে ব্যঙ্গ করলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাতে এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ডাক দেওয়া বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে মেয়েরা হলের তালা ভেঙে বের হয়ে আসে। ক্যাম্পাস পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ মুখতার ইলাহী হলের সন্ত্রস্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা দেশি অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ এই দিনে ‘রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনে’ রূপ নেয়।
ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার কারণে নেতৃত্বস্থানীয় অনেকে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। যখন চরম নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, তখন নেতৃত্বে এসে যুক্ত হন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আশিকুর রহমান আশিক ও আকিব ভাই।
১৫ জুলাই আবু সাঈদ ভাই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছিলেন, তখনই কোনো কর্মসূচি দিতে সম্মত ছিলেন না। তবে আন্দোলনের পটপরিবর্তনের সময় ধারাবাহিক কর্মসূচি জারি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জাব্বার, সাংবাদিকতা বিভাগের দীপ্ত তালুকদার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শাওনসহ আমরা কয়েকজন আবু সাঈদ ভাইয়ের ছাত্রাবাসে যাই। তাঁর সম্মতি নিয়ে কর্মসূচি হাতে নিই।
কর্মসূচি ঘোষণার পর নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি, দেশি অস্ত্র হাতে আমাদের জমায়েতের স্থান ছাত্রলীগ আগেই দখলে নিয়েছে। আমরা কর্মসূচি পালন করতে পারিনি। আমরা তাৎক্ষণিক জরুরি সভা ডাকি। অবস্থা সেদিন এতটা ভয়াবহ ছিল যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোথাও একত্র হতে পারছিলাম না। তাই কারমাইকেল কলেজের কাছে গিয়ে সভা করি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী রিনা মুর্মুর সভাপতিত্বে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সমন্বয়কদের যুক্ত করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের ওপর নজর রাখছিল।
আন্দোলনের কিছু কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৬ জুলাই কারমাইকেল কলেজের সামনে কর্মসূচির জমায়েত করব। তবে ১৬ জুলাই আসতে আসতে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের কেউ সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দিচ্ছিলেন না। দিলে গ্রেপ্তার বা জরিমানা করা হচ্ছে।
অনেকটা উপায়হীন অবস্থায় গণসংহতি আন্দোলন রংপুরের নেতা তৌহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি শুরু থেকেই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেন।
১৬ জুলাই সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় করে আমি, আশিক ভাই ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনতাসীর বেরিয়ে পড়ি সব সংগ্রহ করতে। সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া না পেয়ে টাউন হলের সামনে থেকে দুটি হ্যান্ডমাইক কিনে নিই। আত্মরক্ষার জন্য তৌহিদ ভাইয়ের নির্ধারিত দোকান থেকে ৫০টি এসএস পাইপ কিনে সেগুলোর সঙ্গে পতাকা বেঁধে নিই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ৫০ জন পতাকাধারী মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেবে, যাতে ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে আমরা অন্তত আত্মরক্ষা করতে পারি।
আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যেখানেই জমায়েতের স্থান দিই না কেন, ছাত্রলীগ আগেই তার দখল নেবে। তাই কর্মসূচি বেলা তিনটায় থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ঘোষণা দিই যে আজকের কর্মসূচি শুরু হবে বেলা ১১টায়।
সিদ্ধান্তটি খুবই কার্যকর ছিল। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর কলেজ, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ শহরের সব স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে কারমাইকেল কলেজের সামনে সংগঠিত হয়। এরপর জনসমুদ্র এগোতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে।
এরপর যে ঘটনাটি ঘটে, তা এই আন্দোলনকে একেবারে পাল্টে দেয়। দুই বাহু মেলে দেওয়া আবু সাঈদ ভাইকে যে বুলেটগুলো বিদ্ধ করল, সেগুলো যেন একেকটি পেরেক হয়ে বিঁধল ফ্যাসিস্টদের কফিনে।
আবু সাঈদ ভাই বা আমিসহ আরও শতাধিক শিক্ষার্থী-জনতা গুলিবিদ্ধ হই। সাঈদ ভাইয়ের ঠিক পেছনেই মাইক হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। প্রাণপণ ডেকেও তাঁকে ফেরাতে পারিনি। তিনি আত্মহুতি দিলেন। কিন্তু সারা দেশের জন্য হয়ে উঠলেন মুক্তির উজ্জ্বল প্রতীক!
শাহরিয়ার সোহাগ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক।
(সুত্র প্রথম আলো)