সবার হাতে হাতে এখন আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম। পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি, কেনাবেচা, লেনদেন, ব্যাংকিং, জরুরি যোগাযোগ সবই হচ্ছে মাত্র ৬ ইঞ্চি একটা স্মার্টফোনে। কোনোভাবেই একে এড়িয়ে চলার সুযোগ বা উপায় নেই। ফলে ইমানদার মুমিনকেও ভাবতে হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে। স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, এমন মানুষ কম। তাই কীভাবে এর ব্যবহার কল্যাণমুখী করা যায়, পরকালীন জীবনে এর ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়, সর্বোপরি পার্থিব পাপাচার থেকে বেঁচে পুণ্যের কাজে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যায়—এসব বিষয়ে আলোচনা করা সময়ের দাবি।
কোরআন তিলাওয়াত: আপনি কোথাও যাচ্ছেন, সবসময় ৩০ পারা কোরআন সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। স্মার্টফোনে কোরআন ডাউনলোড করতে পারেন এবং অনায়াসে দেখে পড়ে নিতে পারেন। গোসল ফরজ হয়নি—এমন অবস্থায় মোবাইলে কোরআন দেখে দেখে পড়া যায়। যাত্রাপথে এদিক-সেদিক চোখ যায়, চোখকে কোরআনের ওপর রাখতে পারেন। কিংবা চোখ বন্ধ রাখতে চাইলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে শুনতে পারেন পবিত্র হারামাইন শরিফাইনের কারিদের তিলাওয়াত। অনেক কারির পুরো ৩০ পারা রেকর্ড কোরআন মোবাইলে রাখা যায়। অফিসে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন এক পারা করে শুনলেও মাসে এক খতম শোনা হয়ে যায়। কোরআন অ্যাপস দিয়ে পড়লে নেট খরচ হয়। তাই পিডিএফ ডাউনলোড করে রাখতে পারেন। পিডিএফ পড়লে নেট খরচ হবে না। কোরআন ছাড়াও অন্যান্য দোয়া-দরুদ সবই স্মার্টফোনে পড়া সম্ভব।
দান-সদকা: দান করতে এখন মসজিদে, মাদ্রাসায়, এতিমখানায় যেতেই হবে, এমন নয়। স্মার্টফোনে বিকাশ, রকেট অ্যাপস ডাউনলোড করা থাকলে অ্যাপস ব্যবহার করেই টাকা পাঠানো যায় খুব কম সময়ে। করোনাকালে যখন দূরে যাতায়াতে ঝুঁকি ছিল, দানশীলরা মোবাইল দিয়েই দান করেছেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা দান প্রকাশ্যে করো তবে তা উত্তম আর যদি তা গোপনে করো এবং অভাবীদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য শ্রেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের মন্দগুলো মোচন করে দেবেন। তোমরা যা করো আল্লাহ তা অবগত আছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭১)। নিজে দান করতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানো যায়।
সামাজিক যোগাযোগ: আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া যায় স্মার্টফোনের মাধ্যমে। এজন্য ফেসবুক মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সুবিধা আছে। আগে দূরের স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া এত সহজ ছিল না। এখন হাতের মুঠোয় সুযোগ অবারিত। বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা, প্রিয়তমা স্ত্রী-সন্তান বা ভাইবোনের সঙ্গে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলা যায়, দেখা যায়। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উত্তম কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিছু মানুষকে আল্লাহতায়ালা দীর্ঘ জীবন দান করেন, তাদের ধন-সম্পদে প্রাচুর্য দান করেন এবং সৃষ্টির পর কখনো তিনি তাদের প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাকাননি। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এটা কীভাবে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘কারণ তারা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে।’ (তিবরানি)। তিনি আরও বলেছেন, প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহতায়ালার কাছে মানুষের আমলনামা উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখে না, তাদের আমল ফিরিয়ে দেওয়া হয়।’ (বোখারি: ৫৯৮৬)
ব্যবসা-বাণিজ্য: বেকারদের জন্য স্মার্টফোন আয়ের মাধ্যম হতে পারে। রিচার্জ, কার্ড বিক্রি, টাকা পাঠানো, বিভিন্ন রকমের বিল পরিশোধের মাধ্যম স্মার্টফোন। এসব কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করা যায়। স্মার্টফোনের মাধ্যমে হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করা যায়। ফরজ নামাজের পর হালাল উপার্জনও একটি ফরজ (বায়হাকি: ৮৪৮২)। তা ছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী (সা.), সত্যবাদী ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী (শহীদের) সঙ্গী হবে।’ (তিরমিজি: ১২০৯)। অনলাইনে এখন হাজারো পথ রয়েছে উপার্জনের। বৈধ উপায় যেমন রয়েছে, তেমনি অবৈধ উপায়ও রয়েছে। একজন ইবাদতগুজার ব্যক্তি অনলাইনে বৈধ পেশা অবলম্বন করলে হালাল উপার্জন ও ফরজ পালনের সওয়াব লাভ করবেন।
অপব্যবহার রোধ: স্মার্টফোনকে তুলনা করা যায় আগুনের সঙ্গে, যা দিয়ে রান্নাও করা যায় আবার জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায় অমূল্য সম্পদ। স্মার্টফোনেও অর্জন করা যায় পুণ্য কিংবা নিঃশেষ করা যায় সব পুণ্য ও ভালো বিষয়। স্মার্টফোনের ইতিবাচক ব্যবহার ও নেতিবাচক ব্যবহার দুটোই চলে। বরং বলা যায়, শয়তানের ধোঁকায় অনেক মানুষ একে খারাপ কাজেই ব্যবহার করে এবং জানেও না যে, এর মাধ্যমে সওয়াবের কাজ করা যায়। আসলে এটা নিরীহ একটা বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। বাস্তবে যা ভালো, স্মার্টফোনেও তা ভালো। বাস্তবে যা খারাপ, স্মার্টফোনেও তা খারাপ। তাই অশ্লীল ও খারাপ বিষয় থেকে বিরত থাকতে হবে। ভালো ও সুন্দর বিষয়গুলো স্মার্টফোনেও আঁকড়ে ধরতে হবে। অনেক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সারা দিন স্মার্টফোন নিয়ে পড়ে থাকে। অপ্রয়োজনীয় কাজে সময়ের অপচয় করে। চোখের গুনাহ তো হয়ই, আবার যা-তা লাইক-শেয়ার করেন, ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেন। জীবনের সময়গুলো স্মার্টফোনে নয়, আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করতে হবে। কিংবা স্মার্টফোনকেই বানিয়ে ফেলতে হবে ইবাদতের মাধ্যম।