[ad_1]
মাঝরাতে পাশের বাড়ির এক প্রসূতির প্রসবব্যথা শুরু হলো। আশপাশে প্রশিক্ষিত কোনো ধাত্রী নেই। হাসপাতালও অনেক দূরে। নিরুপায় হয়ে ডাকা হলো কিশোরী আমেনা বেওয়াকে। এর আগে ডেলিভারি করার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার, পারিবারিকভাবেই নারীর স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার অভিজ্ঞতা থাকায় শুরু করলেন চেষ্টা। সে যাত্রায় সফল হলেন তিনি। কোলে তুলে নিলেন নবজাতককে। তারপর শিশুর কান্নার সঙ্গে আমেনার হাসির গল্পের সাক্ষী এখন কয়েক প্রজন্ম।
আমেনা বেওয়ার এই অসামান্য অবদানকে অভিবাদন জানিয়ে তাকে সম্মাননা দিয়েছে কালবেলা পরিবার। রংপুরে ‘কালবেলা উৎসবে’র মধ্যমণি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। এ সময় তাকে জানানো হয়, ‘মাটিকে স্পর্শের আগে তোমার ছোঁয়ায় সিক্ত নবজাতক এখন প্রজন্মের সাক্ষী। আর তুমি সাক্ষী মহাকালের।’
স্পষ্ট মনে না থাকলেও ষাটের দশকে ধাত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেছেন বলে জানান আমেনা বেওয়া। তারপর গ্রামের পর গ্রাম ছুটে ছুটে অক্লান্ত পরিশ্রমে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার নবজাতককে। নানা সংকট আর অভাবের তাড়নাও তাকে থামাতে পারেনি এ মানবসেবা থেকে। তাই তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কাছে হয়ে উঠেছেন আস্থার নাম।
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার কাশিয়াগাড়ি ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামে ১৯৪৭ সালে ১০ ডিসেম্বর জন্ম নেন আমেনা বেওয়া। ১৯৬০ সালের দিকে ১৩ বছর বয়সী কিশোরী আমেনার বিয়ে হয় একই এলাকার মো. জব্বার হোসেনের সঙ্গে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তার বৈবাহিক জীবন শুরু হয়। একাত্তরের যুদ্ধকালীন স্বামীর হাত ধরে ছয় বছর বসয়ী কন্যাসন্তান জোলেখা বেগমকে নিয়ে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নে জদ্দিপাড়ায় এসে সরকারি খাসজমিতে ঠাঁই নেন আমেনা।
এক ছেলে ও দুই মেয়ের জননী আমেনা বেওয়ার সুখের সংসার চলছিল। আশির দশকে হঠাৎ তার স্বামী মারা যান। পরে মারা যায় বড় ছেলেও। স্বামী ও ছেলের মৃত্যুর পর বড় একা হয়ে যান তিনি, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তবে থেমে থাকার মন্ত্রণা তাকে ছুঁতে পারেনি, শুরু করেন ধাত্রীর কাজ।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে আমেনা বেওয়া কালবেলাকে বলেন, খুব কম বয়স থেকে এ কাজ শুরু করেছি। তখন আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু একজনের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর অনুভূতি থেকে ধাত্রী হিসেবে অন্তঃসত্ত্বাদের প্রসব বেদনার সময় পাশে থেকে কাজ করেছি। সেই তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মানুষের সেবা করছি।
ধাত্রীর কাজ কখন কীভাবে শুরু করেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিক মনে নেই—কত সালের ঘটনা। তবে যুদ্ধের অনেক আগে পাশের বাড়ির এক অন্তঃসত্ত্বার প্রসব বেদনা শুরু হলে আমি সেখানে উপস্থিত থেকে সহায়তা করি। তারপর থেকে আমার এ পেশায় কাজ শুরু। তবে ১৯৭৭ সালে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের দিন নিজের মেয়ের বাচ্চা প্রসবের জটিলতার কথা জানিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি।
তিনিও ঝুঁকি নেন না জানিয়ে বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ রংপুরে কয়েকটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে, কোনটি স্বাভাবিক প্রসব হবে। তবে প্রসবকালীন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেই ঝুঁকি না নিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানোর পরামর্শ দিই।
আগের তুলনায় এখন নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা অনেক কমেছে মন্তব্য করে আমেনা বলেন, আগে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫টি বাচ্চা প্রসব করাতে হতো, অথচ এখন ছয় মাসেও ২০টি সন্তান নরমাল প্রসব করে না। সবাই ক্লিনিকে যায় আর সিজার করে। অন্তঃসত্ত্বাদের সম্ভ্রম রক্ষা ও অনাগত সন্তানকে স্বাভাবিকভাবে ভূমিষ্ঠ করার জন্য আমি কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন সুস্থ আছি এ কাজ করে যাব। তবে কারও কাছ থেকে টাকা-পয়সা দাবি করি না। অনেকেই খুশি হয়ে আমাকে উপহার দেন।
আমেনা বেওয়া বলেন, আয়-রোজগার করার মতো কেউ নেই। বয়স্ক ভাতা আর নাতি-নাতনি ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় সংসার চালাচ্ছি। ছেলের বিধবা স্ত্রী ও দুই নাতি-নাতনি নিয়ে সরকারি যে খাসজমিতে বাড়ি করে আছি, তা বন্দোবস্ত হলে শান্তিতে থাকতে পারতাম।
ধাত্রী আমেনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান উপকারভোগীরা। উপজেলার কুর্শা ডাঙ্গাপাড়ার মোসলেমা বেগম কালবেলাকে বলেন, আমার প্রথম সন্তান মোস্তাকিমের বয়স এখন ১৯ বছর। তার জন্মের সময় অনেক ভয় কাজ করছিল। কিন্তু আমেনা চাচির সহযোগিতায় খুব অল্প কষ্টেই আমার সন্তানের জন্ম হয়। আমি তেমন কোনো কষ্ট পাইনি, বাচ্চাও সুস্থ ছিল। চাচির প্রতি আমরা আজীবন কৃতজ্ঞতা থাকব।
জদ্দিপাড়া গ্রামের মোতমাইন্না বেগম বলেন, আমার প্রসবব্যথা ওঠার পর আমেনা খালাকে ডাকি। তিনি শুনেই চলে আসেন। বাচ্চা কখন ভূমিষ্ঠ হয়েছে, আমি বুঝতেই পারিনি। আমার তিন সন্তানের জন্মের সময় তিনি ধাত্রী হিসেবে সেবা দিয়েছেন। তার অবদান কখনো ভুলতে পারব না।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, সচেতনতার অভাবে সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেরই প্রসব বেদনা নিয়ে বাড়িতে দীর্ঘসময় ধরে চেষ্টার পর হাসপাতালে গিয়ে প্রসব জটিলতায় সিজারিয়ান করানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
রংপুর বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন সিজারিয়ানের হার বেড়েছে। আমরা নরমাল ডেলিভারি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। স্বাভাবিক ডেলিভারি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ এবং জরুরি ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সিজারিয়ানের দরকার হয়; কিন্তু সিজারিয়ান উদ্ধেগজনকভাবে বাড়ছে। আমরা মডেল ফ্যামিলি সেন্টারের মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারির উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি সিজারিয়ানকে অনুৎসাহিত করছি। গ্রামাঞ্চলে যারা ধাত্রী হিসেবে কাজ করেন, তাদের সুযোগ সাপেক্ষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
সরকারি সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমলেও প্রতি ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন ১৫৬ জন মা। প্রতিবছর গর্ভাবস্থা ও প্রসব-জটিলতায় চার হাজারের বেশি মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এটি ৭০-এ নামিয়ে আনার চেষ্টা হলেও এটি অর্জনে এখনো বাংলাদেশ অনেক দূরে রয়েছে। এদিকে দেশে অন্তঃসত্ত্বাদের স্বাভাবিক প্রসবের ৭৮ শতাংশই হচ্ছে মিডওয়াইফদের হাতে।
বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটির (বিএমএস) সংশ্লিষ্টরা দাবি করে বলেন, দেশে বছরে প্রায় ৩৬ লাখ শিশুর জন্ম হয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সনদধারী ও দক্ষ মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হয় না। সরকারিভাবে নজরদারিও কম। এ সুযোগে অসাধু প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকরা প্রসূতিদের সিজারে উৎসাহিত করছেন।
[ad_2]
Source link