কুমিল্লা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (কুমেক) আইসিইউ বন্ধের পথে। ৪ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না আইসিইউর চিকিৎসকরা। একই অবস্থা নার্সসহ কর্মচারীদের। করোনার সময়ের জরুরিভাবে নেওয়া প্রকল্পে চালু করা হয় এসব আইসিইউ (ইনসেন্টিভ কেয়ার ইউনিট)।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যা ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ শয্যার এমন আইসিইউও সেবা রয়েছে। জরুরি এই সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
এদিকে বেতন পরিশোধ ও চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে ঢাকায় আন্দোলন করছেন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা। কর্মবিরতিও চলছে। তারপরও সেবা চালু রয়েছে। বহু আগ থেকেই এই হাসপাতালগুলোতে আইসিও সেবা চালু করার দাবি ছিল কুমিল্লাবাসীর। এখন তারা তা চালু রাখার দাবি জানিয়েছেন।
রোববার (৪ মে) কুমিল্লা সদর হাসপাতালের ১০ শয্যার আইসিইউতে রোগী ছিলেন ৩ জন। চাহিদা থাকলেও নতুন কোনো রোগী তোলা যাচ্ছে না।
আইসিইউর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আবদুল মুক্তাদির কালবেলাকে জানান, চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীরা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বেতন পাচ্ছি না। আমাদের চাকরি আছে কি নাই তা-ই কেউ স্পষ্ট করে বলছে না। এসব নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আন্দোলন চলছে ঢাকায়। কর্মবিরতিও চলছে। কর্মচারীরা ওখানে থাকায় নতুন রোগী তোলা যাচ্ছে না। চাকরির নিশ্চয়তা না থাকলে কেমন করে সেবা দেবে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্প জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ৬ মাস আগেই গত বছরের ডিসেম্বরে বলা হয় প্রকল্প বন্ধ। তবে সবাই আউটসোর্সিংয়ের নিয়মানুযায়ী বেতন পাবেন। কিন্তু তাও পাচ্ছি না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর হাসপাতালে প্রায় ২৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দিয়ে করোনাকালীন শেষ সময়ে আইসিইউ খোলা হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে তা চালু করা যাচ্ছিল না। পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোস্টিং হওয়া তাকে দিয়েই ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর ইউনিটটি চালু করা হয়। নিয়মানুযায়ী আরও দুজন এমও (মেডিকেল অফিসার) প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পের অধীন তারাও নিয়োগ পান।
এছাড়াও প্রকল্পের অধীনে রয়েছেন- ৩ জন নার্স এবং আয়া, ওয়ার্ড বয় ৬ জন। এ হচ্ছে লোকবল। তারপরও নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। আইসিইউ শয্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। অন্য দুজন চিকিৎসক হলেন ডা. তানিয়া ও ডা. চয়ন। কুমিল্লা সদর হাসপাতালের আইসিইউ পুরোটাই প্রকল্পের অধীনে চলছে, তাই এখন বন্ধের পথে। করোনাকালীন চালু করা ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে আগে থেকেই। নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট ছিল। করোনার শেষ সময়ে ১০ শয্যার আইসিইউ চালু হয়। রোববার একটি শয্যা ফাঁকা ছিল। হাসপাতালে সাধারণত আইসিইউ শয্যা খালি থাকে না।
রোববার ভর্তি রোগী নজরুল (৫০) ও খোদেজার (৭০) স্বজনরা জানান, সরকারি আইসিইউ সেবা না থাকলে তাদের চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তারা এই সেবা জরুরি ও চালু রাখা প্রয়োজন বলে জানান।
কুমেক আইসিইউর দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মঈন উদ্দীন জানান, ১০ শয্যার আইসিইউর জন্যে তার মতো সারা দেশে ৮৪ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয় করোনাকালীন প্রকল্পের অধীনে। এছাড়া একজন রেজিস্ট্রার ও একজন সহকারী রেজিস্ট্রারসহ ৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন। তিনি ছাড়া বাকি দুজন এমও প্রেষণে অন্য উপজেলা থেকে অতিরিক্ত দায়িত্বে আনা। তারা নিয়মিত হওয়ায় তাদের বেতন চলছে।
তিনি জানান, এভাবে নিয়মিত ও হাওলাতি চিকিৎসক দিয়ে চালানো হচ্ছিল আইসিইউ। এছাড়া নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়া আছেন। তারা আবার প্রকল্পের আওতায়। এমন কর্মচারী রয়েছেন সারা দেশে ১ হাজার ৪ জন। তাদের সবার বেতনও চার মাস ধরে বন্ধ।
তিনি আরও জানান, একই সঙ্গে ১০ শয্যার এইচডিইউতেও (হাই ডিপেনডেনসি ইউনিট) চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন এই তিন চিকিৎসক। প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে তাদের চাকরি চলে যাবে। আইসিওতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকবে না। ওই দুজন এমও হয়ত থাকবেন। এতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আইসিইউ।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক একজন অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কুমিল্লার মতো একটি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকসহ লোকবল সংকটে আইসিইউর মতো জরুরি সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তা ভাবতেই অবাক লাগছে। অবশ্য তার আগে ৫শ শয্যার এ হাসপাতালে আইসিইউ ছিলই না। আরেকটি ১০ শয্যার ইউনিট খোলার উদ্যোগ সেসময় নেওয়া হলেও তা চালু করা যায়নি। এতে নষ্ট হচ্ছে দামি কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি। কারণ আওয়ামী লীগ আমলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মালিকরা চায়নি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চালু হোক। তারা আবার চিকিৎসক ও চিকিৎসক সংগঠনের বড় নেতাও ছিলেন।
ডা. মঈন উদ্দীন আরও বলেন, প্রথমে ইউএনএফপিএ পরে ইআরপিপি (ইমারজেন্সি পেনডামিক প্রিপেয়ারনেস) প্রকল্পের আওতায় করোনাকাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই তহবিল নেই এই অজুহাতে বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে চিকিৎসক, নার্স, আয়া এবং ওয়ার্ড বয় সবাই হতাশায় ভুগছেন। তার মতে অসহায় রোগী ও স্বজনদের চিকিৎসা পাওয়ার আর্তনাদ দেখলে কষ্ট লাগে। আইসিইউর একটি খালি শয্যার জন্যে রোগীর অপেক্ষা ও তদবির কী পরিমাণে রয়েছে তা শুধু ভুক্তভোগীরাই ভালো জানেন।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের ডা. আবদুল মোক্তাদির আরও জানান, করোনাকাল ২০২০ সালের জুন মাসে তাদের নিয়োগ ও যোগদান। পরে এক বছর প্রকল্প বাড়লো। এরপর আরও এক বছর। এরপর শুরু হলো ৬ মাস করে বাড়ানো। এভাবে আজ পর্যন্ত পৌঁছা। বলা হচ্ছে, প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে ডিসেম্বরে। জুন পর্যন্ত চলবে বেতন প্রকল্প থেকে নয়, আউটসোর্সিং থেকে সরকারি নিয়মে চালিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু এখন বন্ধ হয়ে রয়েছে। তাই চিকিৎসক কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন।
তিনি বলেন, এভাবে চাকরি হয় না। আমাদের ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কর্মচারীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তারা কাজে মনোযোগ হারাতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় আইসিইউ ইউনিট চালু রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর বশির কালবেলাকে বলেন, এটি উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। প্রকল্প ডিসেম্বর থেকে বন্ধ, তবে জুন পর্যন্ত চলবে আশাবাদী আমরা। এরপর কুমেক হাসপাতাল ও কুমিল্লা সদর হাসপাতালের আইসিইউ কীভাবে চলবে তা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবে। বন্ধ হয়ে যাক- আমরা কেউই চাই না।
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান কালবেলাকে বলেন, কুমিল্লায় সরকারি বড় দুটি হাসপাতাল কুমেক ও সদর হাসপাতালে আইসিইউ ছিল না। করোনার শেষ সময়ে প্রকল্পের অধীন চালু হয়। এর চাহিদা রয়েছে, প্রয়োজন। প্রকল্প শেষ হলেও আইসিইউ সেবা চালু রাখার দাবি জানাচ্ছি।