বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া এক নীরব প্রাণঘাতী ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং হাজার হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে। এই জিনগত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর নিয়মিতভাবে রক্ত তৈরি করতে পারে না। ফলে বেঁচে থাকতে তাদের মাসে একবার থেকে দুবার রক্ত নিতে হয়।
রক্তের ওপর নির্ভরশীল জীবন: একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর বছরে প্রয়োজন গড়ে ১৫ থেকে ২০ ব্যাগ রক্ত। একজন সুস্থ মানুষ প্রতি চার মাসে একবার নিরাপদে রক্ত দিতে পারেন। এই হিসাবে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর এক বছরের রক্তের চাহিদা পূরণ করতে ৫ থেকে ৭ জন সুস্থ রক্তদাতা প্রয়োজন।
কেন বাংলাদেশের রোগীরা বেশি ঝুঁকিতে: উন্নত বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা আধুনিক চিকিৎসা, যথাযথ রক্ত সরবরাহ এবং নিয়মিত চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে ৪০ থেকে ৫০ বছর বা তারও বেশি সময় সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। বাংলাদেশে অধিকাংশ রোগী ২০ বছর বয়সের আগেই মারা যান দুটি কারণে—নিয়মিত রক্তের সংকট এবং রক্তদানে সামাজিক-পারিবারিক ভয়ভীতি ও কুসংস্কার। অনেক রোগী মাসের পর মাস রক্তের জন্য অপেক্ষা করেন। আত্মীয়স্বজন মিলে বারবার রক্ত জোগাড় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
সচেতনতা জরুরি: বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ছয় হাজারের বেশি শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়। বাবা-মা উভয় বাহক হলে প্রতি গর্ভধারণে ২৫ শতাংশ শঙ্কা থাকে শিশুর থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার। রক্তের অভাবে এবং অনিয়মিত চিকিৎসায় রোগীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হন।
করণীয়: থ্যালাসেমিয়ার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, নিয়মিত রক্তদানে উৎসাহ দেওয়া, একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর পাশে দাঁড়ানো, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা (হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস) বাধ্যতামূলক করা, সরকারিভাবে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও রোগী সহায়তায় নীতি গ্রহণ।
রক্তদাতা সংগ্রহ প্রক্রিয়া: রোগীকেন্দ্রিক রক্তদাতা গোষ্ঠী গঠন। প্রতিটি রোগীর জন্য একটি ‘রক্ত বন্ধু দল’ গঠন, এই ১০ থেকে ১২ জনের একটি ছোট দল বছরে পালাক্রমে রক্তদান করবে। রোগী ও দাতার নাম, ফোন নম্বর, ব্লাড গ্রুপ নিয়ে একটি রেজিস্টার বা ডিজিটাল ফর্ম তৈরি করা এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। প্রতিটি মসজিদ কমিটি একজন নির্দিষ্ট রোগীর জন্য ১০ জন দাতার দল গঠন করে দেবে। মসজিদে একটি রক্তদাতা তালিকা বোর্ড স্থাপন। কলেজ-বিশ্বিবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে রক্তদান ক্লাব গঠন করতে হবে। স্থানীয় দোকান মালিক সমিতি, চেম্বার, পেশাজীবী সংগঠন প্রত্যেকে একজন রোগীর দায়িত্ব নিতে পারে। আপনার একটি পদক্ষেপ বদলে দিতে পারে একটি জীবন।
ডা. আশরাফুল হক
সহকারী অধ্যাপক, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ,
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ