Homeদেশের গণমাধ্যমেপূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ ভাগ হয়েছিল কেন?

পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ ভাগ হয়েছিল কেন?


হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী ভারত ভাগের সময় যুক্ত বাংলা চেয়েছিলেন। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে, এমনটাই চাওয়া ছিল তার। এতে সায় ছিল মহাত্মা গান্ধীরও। কিন্তু তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল। এই দাঙ্গার প্রভাব পড়েছিল দেশ ভাগেও। কীভাবে ভারত ভাগ হয়েছিল, আর সেই ভাগে বাংলা দিখণ্ডিত হয়েছিল চলুন সেই ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। 

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ভাগ করে তৈরি হয়েছিল দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র। লাখ লাখ মানুষ ছিন্নমূল হয়েছিলেন, ভেঙে গিয়েছিল অনেক পরিবার। ১৯৪৭ সালের ৩ রা জুন তৎকালীণ বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভারত ভাগের ঘোষণা করলেন তার কয়েক মাস আগের কথা, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি থেকে সদ্য পদত্যাগ করা শরৎচন্দ্র বসু সেই সময় প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কমিউনিস্ট নেতা আবুল হাসেমসহ বেশ কয়েকজন নেতা চিন্তা-ভাবনা করছিলেন যে, কীভাবে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত হওয়া থেকে বাঁচানো যায়। তারা যৌথভাবে তৈরি করলেন ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল প্ল্যান’ বা  যুক্ত বঙ্গ প্রস্তাব। তারা চেয়েছিলেন, পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম বাংলা সংযুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হোক। ’’

হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-এর নেতৃত্বে যখন মুসলিম লীগ দ্বিজাতি তত্ত্ব অনুসারে ভারতকে দুইভাগে ভাগ করতে চাইছেন, সেই দলেরই নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী তখন চূড়ান্ত করছেন যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব। 

আলিমুজ্জামান, সোহরাওয়ার্দী গবেষক বলেন, ‘‘সোহ্‌রাওয়ার্দীর যে রাজনীতি সেটা মুসলিম লীগের হলেও বাংলা নিয়েই তার রাজনীতি ছিল। যখন দেখলেন যে বাংলা পাকিস্তানের দিকে চলে যাচ্ছে, বা ভারতের দিকে চলে যাচ্ছে সেটাতে তার আপত্তি ছিল। বাঙালি জাতিয়তাবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। এই কারণেই তিনি যুক্তবঙ্গ চেয়েছিলেন।’’

১৯৪৭ এর ৯ মে গান্ধী কলকাতায় আসেন। ট্রেন থেকে নেমেই চলে গিয়েছিলেন সোদপুরের খাদি প্রতিষ্ঠানে। যেখানে তিনি  আগেও একাধিকবার দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। সেখানেই একের পর এক নেতা নিয়ে তিনি যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব প্রসঙ্গে আলোচনা সেরেছিলেন। 

সুগত বসু, গার্ডিনার প্রফেসর অফ হিস্টরি, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, ‘‘ এটা একটা প্রচেষ্টা ছিল। যাতে আমাদের এই উপমহাদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে। এপ্রিল মাসেই তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-এর সমর্থন পান। তারপরে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বেশ কিছু কথাবার্তা হয় মে মাসে। প্রথমে গান্ধী এই প্রকল্পের সমর্থন করেন।’’ 

হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, শরৎবসুর সঙ্গে প্রথম কয়েকদিনের বৈঠকে গান্ধী যে যুক্তবঙ্গ প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন- সেই খবর পত্রিকায় আসতে শুরু করে। এরপরে গান্ধীর বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠেন হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী। সোদপুরে গিয়ে গান্ধীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। 

শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী গান্ধীকে বলেন, ‘‘যিনি এই যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব এনেছেন তিনি বাংলার পাটশিল্পকে বাঁচাবার জন্য আগ্রহী। যখন যুক্তবঙ্গ তৈরি হয়ে যাবে, পরবর্তীতে তিনি তার প্রভাব খাটিয়ে পশ্চিমবাংলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দেবেন।’’  

সুগত বসু, গবেষক বলেন, ‘‘ লর্ড মাউন্টব্যাটেন ২৮ মে ১৯৪৭ এ লন্ডনে দুইটি বক্তৃতা রেডি করলেন। ‘ব্রডকাস্ট এ’ এবং ‘ব্রডকাস্ট বি’ ব্রডকাস্ট এ-তে বলা হয়েছিল পাঞ্জাব এবং বাংলা দুই রাজ্য ভাগ হবে। কিন্তু ব্রডকাস্ট বি-তে বলা হলো, বাংলার হিন্দু এবং মুসলমান নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, একটি কোয়ালিশন গঠন হবে। এবং বাংলা ভাগ হবে না। এই দুই ব্রডকাস্ট রেকর্ড করে উনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে এলেন। কিন্তু ৩০ মে, কংগ্রেসের দুই নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং বল্লভ ভাই প্যাটেল ব্রডকাস্ট বি-তে ঘোর আপত্তি জানালেন, একেবারে কেটে দিলেন আরকি।’’

কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতা যুক্তবাংলার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করাই ভালো হবে।  তারা বাংলা ভাগ করার দাবিতে হিন্দু মহাজোটের নেতাদেরও পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন। 

শুধু যে কংগ্রেসের হাই কমান্ড বাংলা ভাগ করার পক্ষে বেঁকে বসেছিলেন তা নয়। ১৯৪৬ এর দাঙ্গার পর থেকে হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বাংলার হিন্দু সমাজের মধ্যেই।  সোহ্‌রাওয়ার্দীর যে যুক্তবাংলা চাচ্ছিলেন তাতে হিন্দু মহাজোটের সাঁই না থাকার কারণ ছিল সেটাও। 

গবেষক আলিমুজ্জামান বলেন, ‘‘১৯৪৬-এর যে দাঙ্গা সেই দাঙ্গাতে মানুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিল।’’

পূর্ব এবং পশ্চিমবাংলার জনপ্রতিনিধিরা একসঙ্গে এবং পৃথকভাবে ভোট দিয়ে বাংলা বিভাজন চূড়ান্ত করেন ১৯৪৭ এর ২০ জুন।  দুই বাংলার জন প্রতিনিধিরা যখন যৌথভাবে ভোট দেন, তাতে বিভাজনের বিরুদ্ধেই গিয়েছিল ফলাফল। তবে পশ্চিববঙ্গের জনপ্রতিনিধিরা আলাদাভাবে ভোট দেন বাংলা ভাগের পক্ষে। পূর্ব বাংলার জন প্রতিনিধিরা ভোট দিয়েছিলেন দুই বাংলা এক রাখার পক্ষে। 

যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রতিনিধিরা দুই বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন তাই সেইদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল দুই বাংলা যুক্ত করার সব সম্ভাবনা। 





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত