Homeলাইফস্টাইলএই হোক শেষ পরিচয়

এই হোক শেষ পরিচয়


ঢাকা থেকে বন্ধুরা বলে দিয়েছিল, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বললেই যেকোনো ট্যাক্সিওয়ালা চোখ বুজে নিয়ে যাবেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। কলকাতায় এসে বুঝলাম, চোখ বুজে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার দিন শেষ।

দু-তিনজন ক্যাবচালক ‘ঠিকানা জানি না’ বলে জানালেন। কলকাতার ট্যাক্সিচালকেরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি খুব একটা চেনেন না। তবে হনুমান মন্দির বললে চিনে ফেলেন চটপট। শেষ পর্যন্ত একজনকে পেলাম, যিনি আমাকে ও আমার মাকে নিয়ে গেলেন গুরুদেবের বাড়ির পথে।

প্রথমবারের মতো যাচ্ছি। তাই মনের ভেতর কে যেন তাড়া দিচ্ছে, কতক্ষণে পৌঁছাব! জাকারিয়া স্ট্রিটের নাখুদা মসজিদ পেরিয়ে চিতপুর রোড দিয়ে এগিয়ে চলছি। শেষ পর্যন্ত দেখা মিলল বিশাল তোরণে লেখা ‘জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি’। এরপরই বেশ খানিকটা ঘিঞ্জি গলি। ভেতরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ। সেখান থেকে খানিকটা ভেতরেই মিউজিয়াম। ঠাকুরবাড়িতে যাওয়ার রাস্তা যেমনই হোক, বাড়িটা দেখার মতো। আঠারো শতকের শেষের দিকে দ্বারকানাথ ঠাকুরবাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বড় বাজারের শেঠদের জমিতে। ধীরে ধীরে এই পাড়া হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের বহু বিখ্যাত ঘটনার সাক্ষী। এ পাড়াতেই থাকতেন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশার’ লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ, ভারতবর্ষে ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক প্রথম অভিনীত হয়েছিল যাঁর বাড়িতে, সেই পিয়ারি মোহন বোস, মাইকেল মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল যাঁর উদ্যোগে, সেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মানুষ।

সবুজ ছোট-বড় বৃক্ষাদির শাখা-প্রশাখা আর পত্রপল্লবে ঘেরা চারদিক। তারই ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে লাল রঙের বিশাল আকৃতির একাধিক দালান। মাঝে বিশাল সবুজ চত্বর দেখেই মনে হয়, বসে পড়ি ঘাসের কোমল ছোঁয়া পেতে। কিন্তু মিউজিয়ামে দ্রুত ঢোকার লোভও সামলাতে পারছি না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদাদা নীলমণি ঠাকুর এই জোড়াসাঁকোর বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রাঙ্গণ। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার ঠিক বাঁ দিকের দালানটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রবেশপথের ডান দিকের একটু ভেতরে একচালা গ্যারেজে রাখা আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত গাড়ি। এখানে আসা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাঁদের কেউ বিহার, কেউবা পাটনা থেকে এসেছেন। এখানে এমনকি বন্ধের দিনও মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে। ঠাকুরবাড়িতে আসা দর্শনার্থীদের একটু অন্য রকম মনে হয়! তাঁদের কেউবা ব্যস্ত লেখার মধ্যে, কেউবা অকারণে বসে আছেন সবুজ চত্বরে, কেউবা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আবার অনেকে একসঙ্গে গোল করে বসে আলোচনায় মশগুল।

ক্যামেরার-চোখে

নিচতলায় ২০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে, সিঁড়িঘরের নিচের লকারে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ব্যাগ—এসব রেখে, জুতা খুলে আমরা বাড়ির ওপরতলায় গেলাম।

‘আমি কান পেতে রই, ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে…’

কোথায় যেন মৃদু শব্দে সংগীত বেজে চলেছে, অসাধারণ পরিবেশ। সেই মূর্ছনায় আমি কান পেতে এগিয়ে যাই। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকি, একসময় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাই। দেখতে পাই রবিঠাকুরের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো ওপরতলায় বিভিন্ন ঘরে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের খাবারঘর। এরপর শয়নকক্ষ। ভেবেছিলাম, খুব একটা বড় হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করা গেল, বাড়িটি বিশাল। প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে রবিঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন। কোনো কোনো ঘরে তাঁর ব্যবহৃত পোশাক, আরামকেদারা, বইপত্র, বিলেত থেকে আনা নানা জিনিসপত্র। রয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। একটি ঘরে রয়েছে রবিঠাকুরকে লেখা মৃণালিনী দেবীর চিঠি। তার ওপর মৃণালিনী দেবীর একটি বড় ছবি টাঙানো।

প্রবেশ-পথ

পুরো বাড়িতে প্রতিমুহূর্তে বেজে চলেছে সংগীতের অসাধারণ সব সুর। খাবারঘরটিও সংগীতকক্ষের মতো করে সাজানো। পরের ঘরটিতে কবি শুয়ে কাটাতেন জীবনের শেষ সময়টা। সেখান থেকে বের হয়েই দেখা গেল কলকাতার বিখ্যাত বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার’-এ প্রকাশিত কবির জীবনের শেষ দিনটির কথা। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট প্রকাশিত আনন্দবাজার দেখে একটু অবাকই হতে হলো। সেখানে লেখা, ‘আজ প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ৬৫ হাজার’। পত্রিকার পাতাজুড়ে কবির শেষযাত্রার সংবাদ আর কবিতা।

কালো মেঝের জলচৌকিতে জ্বলছিল রবীন্দ্রনাথের শেষনিশ্বাস ত্যাগের সময় থাকা ধূপবাটি। সেখান থেকে বের হয়ে কিছুদূর যেতেই দুই দরজার ছোট্ট একটি ঘর। সেখানে আলো খুব একটা নেই। এটি কবিগুরুর আঁতুড়ঘর।

তিনতলায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আর সারদা দেবীর ঘরসংসার। সারদা দেবী ছিলেন আমাদের যশোরের মেয়ে। আট বছর বয়সে তিনি ঠাকুরবাড়ি এসেছিলেন বউ হয়ে। কর্তার দেখা খুব একটা না পেলেও সংসারের কর্তৃত্ব ছিল তাঁর।

রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়ামের লাইব্রেরিটিও সমৃদ্ধ নানান দুষ্প্রাপ্য বইয়ে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নাল এখানে নিয়মিত আসে। মোট ৪টি ভবনের ১৮টি গ্যালারিজুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই এখানেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ লেখার ডিকটেশন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাত দিন পর তিনি পাড়ি জমান না-ফেরার দেশে। পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুরবাড়ির দরজা। তাই অগত্যা বেরিয়ে আসতে হয়।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত