Homeলাইফস্টাইলযুক্তরাষ্ট্রের যে দ্বীপে মোটরগাড়ি নেই

যুক্তরাষ্ট্রের যে দ্বীপে মোটরগাড়ি নেই


এই একুশ শতকে কোনো এলাকায় মোটরগাড়ি চলে না, এটা বিশ্বাস করা যায়! অবিশ্বাস্য হলেও খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি দ্বীপ আছে, যেখানে মোটরগাড়ি নেই। নেই যুক্তরাষ্ট্রের আভিজাত্যের প্রতীক গলফ কোর্টও। কিন্তু সেই দ্বীপের বাসিন্দাদের সবার জন্য আছে একটি করে ঘোড়া। সেই সব ঘোড়ায় চলাফেরা করে তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যকে বলা হয় ‘গাড়ির রাজধানী’। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ফোর্ড, জেনারেল মোটরস কিংবা ক্রাইসলারের মতো বড় বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গাড়ির রাজধানী মিশিগানের উত্তরে লেক হিউরন হ্রদের মাঝখানে ম্যাকিনাক আইল্যান্ড নামে যে ছোট্ট দ্বীপটি আছে, সেখানে কোনো মোটর গাড়ি চলে না; বরং ঘোড়ার খুরের ছন্দে আচ্ছন্ন থাকে দ্বীপটি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, প্রকৃতি আর প্রাচীন ঐতিহ্য।

ম্যাকিনাক আইল্যান্ড মাত্র ৩ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দ্বীপ। সেখানে বসবাস করে প্রায় ৬০০ মানুষ আর সমসংখ্যক ঘোড়া। অর্থাৎ ৬০০ মানুষের জন্য ৬০০টি ঘোড়া আছে দ্বীপটিতে।

ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে বসবাস করে প্রায় ৬০০ মানুষ আর সমসংখ্যক ঘোড়া। অর্থাৎ ৬০০ মানুষের জন্য ৬০০টি ঘোড়া আছে দ্বীপটিতে। ছবি: সংগৃহীত

ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে বসবাস করে প্রায় ৬০০ মানুষ আর সমসংখ্যক ঘোড়া। অর্থাৎ ৬০০ মানুষের জন্য ৬০০টি ঘোড়া আছে দ্বীপটিতে। ছবি: সংগৃহীত

গাড়ি নেই কেন

ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে কোনোকালেই যে মোটরগাড়ি ছিল না, তেমন নয়। উনিশ শতকে মোটর গাড়ির উদ্ভব হলে দ্বীপটিতেও কিছু গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু ১৮৯৮ সালে কোনো এক সময় স্থানীয় ঘোড়ার গাড়ির চালকেরা স্থানীয় গ্রাম পরিষদে অভিযোগ জানায়, মোটরগাড়ির শব্দে ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে যায়। ফলে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়। এই অভিযোগের ফলে সেখানকার কর্তৃপক্ষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় মোটর গাড়ি নিষিদ্ধ করার। এরপর পুরো দ্বীপেই এই নিষেধাজ্ঞা চালু হয় এবং আজ পর্যন্ত সে নিয়ম মেনে চলছে দ্বীপটির অধিবাসীরা। এই দ্বীপে সবকিছু হয় ঘোড়ার গাড়িতে। ময়লা ফেলা থেকে চিঠিপত্র বিলি করা এমনকি ফেডেক্সের মতো কুরিয়ার সার্ভিসের প্যাকেট পৌঁছানোর কাজও করা হয় ঘোড়ার মাধ্যমে।

দ্বীপের ইতিহাস

ম্যাকিনাক দ্বীপের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। এই দ্বীপে পাওয়া গেছে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো আদিবাসী কবরস্থানের চিহ্ন। এখানকার প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম অনিশিনাবি। তাদের নিজেদের ভাষায় এই দ্বীপের নাম ছিল কচ্ছপের স্থান। দ্বীপটি দেখতে অনেকটা পানির ওপর ভেসে থাকা বিশাল কচ্ছপের মতো। ১৭৮০ সালে ব্রিটিশরা এখানে দুর্গ তৈরি করে। পরে ১৮১২ সালের যুদ্ধে আমেরিকা দ্বীপটি নিজের দখলে নেয়।

দ্বীপটিতে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি বাইসাইকেল রয়েছে, যেগুলো ভাড়া পাওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত

দ্বীপটিতে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি বাইসাইকেল রয়েছে, যেগুলো ভাড়া পাওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত

এই দ্বীপে যা কিছু দেখার আছে

দ্বীপের ৮০ শতাংশ অঞ্চল ম্যাকিনাক আইল্যান্ড স্টেট পার্কের অন্তর্গত। এখানে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা হাইকিং ট্রেইল, বন, পাথুরে সৈকত এবং আর্চ রক নামের একটি ৫০ ফুট প্রশস্ত প্রাকৃতিক পাথরের খিলান। বাইসাইকেল বা ঘোড়ার গাড়িতে দ্বীপটি ঘুরে দেখার সুযোগ আছে। দ্বীপটিতে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি বাইসাইকেল রয়েছে, যেগুলো ভাড়ায় পাওয়া যায়। দ্বীপের একমাত্র পাকা রাস্তা সাড়ে আট কিলোমিটার দীর্ঘ। এ রাস্তা যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র হাইওয়ে, যেখানে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। ম্যাকিনাক আইল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ গ্র্যান্ড হোটেল। ১৩৮ বছরের পুরোনো এই হোটেল আজও তার রাজকীয়তা ধরে রেখেছে। এই হোটেলের বিশ্ববিখ্যাত ৬৬০ ফুট লম্বা বারান্দাটি বিশ্বের দীর্ঘতম কাঠের বারান্দা হিসেবে পরিচিত। গ্রীষ্মকালে প্রায় ১২ লাখ পর্যটক ম্যাকিনাক দ্বীপে ভ্রমণে যায়। ফেরিতে ম্যাকিনাক সিটি বা সেন্ট ইগনেস থেকে মাত্র ২০ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায় দ্বীপের দক্ষিণের ছোট্ট গ্রামটিতে।

লাইলাক ফেস্টিভ্যাল

ম্যাকিনাক দ্বীপে প্রতিবছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় ১০ দিনব্যাপী লাইলাক ফেস্টিভ্যাল। সে সময় দ্বীপজুড়ে ফুলে ফুলে ঢেকে যায় শতবর্ষী লাইলাক গাছ। মিষ্টি ঘ্রাণের বেগুনি, সাদা, গোলাপি রঙের নানা রকম লাইলাক ফুল দেখা যায় দ্বীপটিতে। আর দ্বীপটির সর্বোচ্চ স্থান ফোর্ট হোমস থেকে দেখা যায় তারাভরা আকাশ। লাইলাক ফেস্টিভ্যালে ঘোড়ার গাড়ি সাজিয়ে রঙিন শোভাযাত্রা হয়, দ্বীপজুড়ে চলে সংগীত পরিবেশন। এ ছাড়া আয়োজিত হয় দৌড় প্রতিযোগিতা এবং বাইসাইকেল ট্যুর। উৎসব চলাকালে দ্বীপে পর্যটকের ভিড় থাকে বেশি। তাই অনেকে সে সময় আগেভাগে হোটেল বুক করার প্রতিযোগিতা চলে সেখানে।

ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে সবকিছু হয় ঘোড়ার গাড়িতে। ময়লা ফেলা থেকে চিঠিপত্র বিলি করা এমনকি ফেডেক্সের মতো কুরিয়ার সার্ভিসের প্যাকেট পৌঁছানোর কাজও করা হয় ঘোড়ার মাধ্যমে। ছবি: সংগৃহীত

ম্যাকিনাক আইল্যান্ডে সবকিছু হয় ঘোড়ার গাড়িতে। ময়লা ফেলা থেকে চিঠিপত্র বিলি করা এমনকি ফেডেক্সের মতো কুরিয়ার সার্ভিসের প্যাকেট পৌঁছানোর কাজও করা হয় ঘোড়ার মাধ্যমে। ছবি: সংগৃহীত

পর্যটকদের চাপ চান না স্থানীয়রা

ম্যাকিনাক দ্বীপের স্থানীয় অধিবাসীরা বাইরের ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে থাকতে চান। তাঁরা নিজেদের মধ্যেই সময় কাটাতে ভালোবাসেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত দ্বীপটিতে বাড়ছে ভ্রমণকারীর সংখ্যা। কিন্তু স্থানীয়রা চান না, পর্যটকের অতিরিক্ত চাপ পড়ে দ্বীপটির শান্তি নষ্ট হোক।

যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে প্রযুক্তির দাপটে দ্রুতগতির জীবনধারা চলছে, সেখানে ম্যাকিনাক আইল্যান্ড এখনো ধরে রেখেছে শতাব্দীপ্রাচীন এক শান্ত, মানবিক জীবনের গতি। আর সেই জগতের প্রতীক হয়ে আছে ঘোড়া, প্রতিদিনের চলাচল, পরিবহন এবং ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে।

সূত্র: বিবিসি





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত