দীর্ঘ শীতকাল আর উচ্চ করের জন্য পরিচিত নর্ডিক দেশ ফিনল্যান্ড। চলতি বছর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে সবচেয়ে সুখী দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে দেশটি। ১৪৬টি দেশের মধ্যে এ নিয়ে টানা অষ্টমবারের মতো এই তালিকায় প্রথম হলো ফিনল্যান্ড। সুখী দেশের তালিকায় শুরুর দিকেই রয়েছে নর্ডিক দেশ ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড এবং সুইডেন। কিন্তু এই অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষ এত সুখী হওয়ার পেছনে কারণ কী?
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে হাসি-আনন্দ নয়, বরং ‘জীবনের প্রতি সন্তোষ ও তৃপ্তি’ সুখ পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। মূলত গ্যালাপের একটি জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ওই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১ থেকে ১০-এর মধ্যে নিজেদের জীবনমানকে নম্বর দিতে বলা হয়। এই জরিপে ফিনিশরা নিজেদের জীবনমানকে গড় ৭ দশমিক ৭ নম্বর দিয়েছেন। যেখানে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর বাসিন্দারা তাদের জীবনের মানকে গড় ৫ দশমিক ৬ নম্বর দিয়েছেন। আর সবচেয়ে অসুখী দেশ আফগানিস্তানের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে গড়ে মাত্র ১ দশমিক ৪ নম্বর দিয়েছেন!
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন ছাড়াও অন্য একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনেও বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল, প্রগতিশীল এবং নিরাপদ দেশ হিসেবে উঠে এসেছে নর্ডিক দেশগুলো। দ্য ইকোনমিস্টের গ্লাস সিলিং ইনডেক্সেও শীর্ষ স্থানে রয়েছে দেশগুলো। গ্লাস সিলিং ইনডেক্স মূলত নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও প্রভাব কতটা তার একটি চিত্র। এ ছাড়া, দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে আত্মহত্যা এবং অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের কারণে মৃত্যুর হার। আগে এই দেশগুলোতে এ ধরনের মৃত্যুর হার খুব বেশি ছিল।
মাথাপিছু আয়ের হিসাবে নর্ডিক দেশগুলো বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলোর কয়েকটি। আয়-উপার্জনও জীবনের প্রতি সন্তুষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখে। তবে এই মাপকাঠিতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোও আলাদা করে নজরে পড়ে—তাদের আয় তুলনামূলকভাবে কম হলেও জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি বেশি। এমনকি তারা অন্য কিছু ‘হ্যাপিনেস’ সূচকে নর্ডিকদেরও ছাড়িয়ে গেছে, যেমন—মানুষ কতটা হাসে বা আনন্দ অনুভব করে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডের নাগরিকেরা খুব একটা হাসে না। তারা গম্ভীর বলেই পরিচিত।
বেশি হাসা বা আনন্দে জীবন কাটানোর তালিকায় লাতিন দেশগুলোর সামনের সারিতে থাকার পেছনে একটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, একা খাওয়ার তুলনায় কারও সঙ্গে বসে একসঙ্গে খাওয়া এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাবারের সময় সঙ্গ থাকা, বেশি আয় করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ—বলছেন তাঁরা। আর লাতিন আমেরিকার দেশগুলো মিল শেয়ারিং বা একসঙ্গে খাবার ভাগাভাগির করার চর্চায় অনন্য। জরিপে দেখা গেছে, ওই অঞ্চলের মানুষ সপ্তাহে গড়ে নয় বার বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে বসে খাবার খান। ফলে ধরে নেওয়া যায়, অন্যদের তুলনায় তাঁরা বেশি সামাজিক এবং কম নিঃসঙ্গবোধ করেন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের জীবন-মূল্যায়নের সঙ্গে জিডিপির চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সামাজিক সহায়তার সূচকগুলো।
এটাই হয়তো ব্যাখ্যা দেয় কেন আমেরিকা ও কিছু ধনী দেশে মানুষ দিন দিন কম সুখী হচ্ছে। সেখানে একা খাওয়া, একা থাকা, এমনকি সুযোগ থাকলে একাই কাজ করতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ১৮ শতাংশ তরুণ আমেরিকান বলেছেন, তাঁদের জীবনে ‘ঘনিষ্ঠ’ বলা যায় এমন কেউ নেই। যদিও সাম্প্রতিককালে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কমেছে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে ওই গবেষণায়।
অনেক দেশেই এখন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কমে যাচ্ছে—বন্ধু, পরিবার বা আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটানো বা মানসিকভাবে যুক্ত থাকার সুযোগ কমে গেছে। এর ফলে অনেকেই নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা বা এক ধরনের একাকিত্বে ভুগছে।
কিন্তু ফিনল্যান্ডে বিষয়টা একটু আলাদা। সেখানে ‘একাকিত্ব’ মানেই দুঃখ বা নিঃসঙ্গতা নয়—বরং তাঁরা একা থাকার সময়টাকে উপভোগ করেন। ফিনিশরা মাঝে মাঝে শহরের ব্যস্ততা থেকে বেরিয়ে গ্রামে বা প্রাকৃতিক পরিবেশে ছোট কটেজে গিয়ে থাকেন—যেগুলোকে তাঁরা মোক্কি বলেন। সেখানে তাঁরা একা থাকেন, বই পড়েন, প্রকৃতি উপভোগ করেন। তাঁদের কাছে একা থাকা মানে নিজেকে সময় দেওয়া, নিজের ভেতরের শান্তি খুঁজে পাওয়া।