Homeলাইফস্টাইলস্ত্রী বেশি আয় করলে পুরুষেরা খুশি হয় না কেন

স্ত্রী বেশি আয় করলে পুরুষেরা খুশি হয় না কেন


সমাজে নারীর অগ্রগতি, বিশেষত কর্মক্ষেত্রে তাঁদের উপার্জন বৃদ্ধি পারিবারিক সম্পর্কে নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে। পুরুষই পরিবারে প্রধান উপার্জনকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিপরীতে যখন স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বেশি আয় করেন, তখন পুরুষদের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে, যা তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই প্রভাবিত করছে না, বরং পারিবারিক ক্ষমতাকাঠামো ও বৃহত্তর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরও ফেলছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। সম্প্রতি এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় অংশ নেওয়া কয়েকজন পুরুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ডেভ নামের এক ব্যক্তি বাড়িতে থাকেন এবং সন্তানদের দেখাশোনা করেন। এ ধরনের পুরুষেরা ‘স্টে-অ্যাট-হোম ড্যাড’ হিসেবে পরিচিত। ডেভ বলেন, আপনার স্ত্রী যখন সব টাকা উপার্জন করছেন, তখন আপনার আত্মসম্মানে কিছুটা আঘাত লাগবে।

টম নামের আরেকজন নিজেকে ‘গাইস গাই’ বা প্রথাগত পুরুষালি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আপনি যখন তাঁদের (বন্ধুদের) বলেন যে আপনি বাড়িতে থাকেন, তখন তাঁরা আপনাকে মেয়েলি স্বভাবের ভাববে। ব্রেন্ডন নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে ‘হাউস বিচ’ (গৃহস্থালি কাজের জন্য অপমানজনক সম্বোধন) হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, যেসব পুরুষ কর্মজীবী নন এবং যাঁদের স্ত্রী পরিবারে মূল উপার্জনকারী, তাঁদের অনেকে সামাজিক বিচার-বিশ্লেষণের মুখোমুখি হন। কারণ, সমাজে দীর্ঘদিন ধরে পুরুষদের মূল উপার্জনকারী হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এখন অনেক নারী তাঁদের স্বামীদের চেয়ে বেশি উপার্জন করছেন। এই পরিবর্তন পারিবারিক শক্তির ভারসাম্য ও সমাজে পুরুষ-নারীর ভূমিকার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যেও এর প্রভাব পড়ছে। কারণ, অর্থের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। যখন একজন পুরুষ নিজের স্ত্রী বা সঙ্গীর চেয়ে কম উপার্জন করেন, তখন তিনি সমাজের চাপে নিজের অবস্থান দুর্বল মনে করতে পারেন। এতে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, এমনকি সম্পর্কেও টানাপোড়েন বাড়তে পারে।

এর আগে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যখন একজন নারী তাঁর সঙ্গীর চেয়ে বেশি আয় করেন, তখন পুরুষের আত্মসম্মান, সুখ ও সম্পর্কের স্থিতিশীলতায় প্রভাব পড়ে। এটি বিশেষত তখনই বেশি হয়, যখন পুরুষটি নিজের কর্মসংস্থান হারিয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য হন।

সুইডেনে ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যখন স্ত্রীরা স্বামীদের চেয়ে বেশি আয় করতে শুরু করেন, তখন পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগনির্ণয়ের হার ১১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। একই অবস্থা নারীদের (৮ শতাংশ) ক্ষেত্রেও দেখা যায়, তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি বেশি। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডেমিড গেটিক জানান, এ ধরনের মানসিক সমস্যা অনেক সময় সম্পর্কের অসন্তোষেরও কারণ হতে পারে।

অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষ স্ত্রীদের চেয়ে কম আয় করেন, তাঁদের মধ্যে প্রতারণার হারও বেশি, যেন তাঁরা এটা করেই তাঁদের পুরুষত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান।

কাজ না থাকলে পুরুষদের মধ্যে বিষণ্নতার হার নারীদের তুলনায় বেশি থাকে। কারণ, নারীদের ঘরের কাজের বাইরে সামাজিক সম্পর্ক বেশি থাকে। অপরদিকে ‘স্টে-অ্যাট-হোম ড্যাড’ অর্থাৎ যাঁরা ঘরে থেকে সন্তান পালন করেন, তাঁদের মাঝে একাকিত্ব বেশি। অস্ট্রেলিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হ্যারি বানটন জানান, চাকরি হারানোর পর তিনি অনুভব করেন ‘একজন মানুষ, স্বামী ও বাবা হিসেবে তাঁর মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে’।

কিন্তু কোনো পরিবারে নারীই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হলে সার্বিকভাবে পরিবারের আয় অনেক সময় কমে যায়। কারণ, নারী-পুরুষের বেতনে এখনো একটি পার্থক্য রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব বাথের সামাজিক নীতি ও বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলেন কোয়ালেভেস্কা বলেন, বেশির ভাগ দেশ নারী-পুরুষের সমতার কথা বললেও নারী-পুরুষের বেতন কাঠামোতে যে পার্থক্য, তা দূর করতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

কর্মক্ষেত্র থেকে পুরুষদের সরে আসা পারিবারিক জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পুরুষেরা যখন কাজ থেকে সরে এসে পরিবারে সময় দেন, তখন সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। যুক্তরাজ্যে আজকাল বাবারা সন্তানদের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটান, যা সন্তানদের জন্য উপকারী। এ ছাড়া পিতৃত্বকালীন ছুটি পুরুষদের বিবাহিত জীবনের সন্তুষ্টি বাড়ায় এবং সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের বন্ধন মজবুত করে। এটি ভবিষ্যতে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ সমতার ধারণাও তৈরি করে।

যেসব দেশে পিতৃত্বকালীন ছুটি রয়েছে, সেখানে বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান। যেমন সুইডেনে ১৯৯৫ সাল থেকে ‘ড্যাডি মান্থ’ চালু হওয়ার পর বাবাদের মধ্যে সন্তানের যত্ন নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এরপর ২০০২ সালে যখন ছুটি বাড়িয়ে দুই মাস করা হয়, তখন সুইডেনের দম্পতিদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও আগের চেয়ে স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমানে সুইডেনে পিতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস।

তবে বিশ্বব্যাপী নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও সামাজিক মনোভাব এখনো পুরোপুরি বদলায়নি। কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক হিজুং চুং বলেন, নারীরা এখন পুরুষদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং কিছু ক্ষেত্রে বেশি উপার্জনও করছেন। তবে কিংস কলেজ লন্ডনের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জেন-জিদের (১৮-২৮ বছর) মধ্যে অনেক পুরুষ এখনো মনে করেন, ঘরে সন্তান দেখাশোনার কাজ করলে একজন পুরুষ তাঁর ‘পুরুষত্ব’ হারান। ২৮ শতাংশ জেন-জি পুরুষ এই বক্তব্যে সম্মত, যেখানে নারীদের মধ্যে এ সংখ্যা মাত্র ১৯ শতাংশ।

গবেষকেরা বলছেন, নারীরা আজকাল শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু পুরুষ হয়তো মনে করছেন, তাঁরা পিছিয়ে পড়ছেন। এর ফলে সমাজে একধরনের বিভাজন তৈরি হচ্ছে।

রাজনীতিবিদ রোজি ক্যাম্পবেল বলেন, তরুণদের মধ্যে তাঁদের পুরুষত্ব ও নারী-পুরুষ সমতার অর্থ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, বিশেষ করে স্কুলপর্যায়ে। তরুণদের সামনে এমন ইতিবাচক পুরুষ আদর্শ রাখা দরকার, যাঁরা দয়া, সহমর্মিতা ও পরিচর্যার কাজকেও পুরুষত্বের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

মোনাশ ইউনিভার্সিটির গবেষক কার্লা এলিয়ট বলেন, যত্ন ও সমানাধিকারের ওপর ভিত্তি করে নতুন পুরুষতান্ত্রিক ধারণাও তৈরি হচ্ছে। তবে এই মানসিকতার প্রসারে পুরুষদের গৃহস্থালির কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে পিতৃত্বকালীন ছুটির মতো নীতিগুলো পুরুষদের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে সাহায্য করতে পারে এবং নারীদের ক্যারিয়ার গড়ায় সহায়ক হতে পারে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমরা সবাই যদি সমাজে পরস্পরের ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করি, তবে পুরুষদের আত্মসম্মান বা পুরুষত্বের বিষয়ে ভুল ধারণা ভাঙতে পারে।

যেহেতু নারীদের উপার্জন বাড়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে, তাই পুরুষদের পারিবারিক দায়িত্বে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তবেই গড়ে উঠবে সমতার সমাজ, যেখানে সম্পর্ক আরও সুখকর হবে; নারীরা পেশাগত অগ্রগতি অর্জন করতে পারবেন এবং পুরুষেরা পরিবারের দেখভালেও পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন।

সূত্র: বিবিসি

মূল লেখা: বিজ্ঞান সাংবাদিক মেলিসা হোগেনবুম, Breadwinners (২০২৫) ও The Motherhood Complex (২০২১) বইয়ের লেখক।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত