[ad_1]
মাহবুবের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেই সে এক মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে এলো যেন সে ফতুয়া পরে আমার জন্যেই তৈরি হয়ে ছিল; আমাকে দেখেই সেই পুরোনো ট্রেডমার্ক হাসি উপহার দিল সাথে বোনাস হিসেবে কয়েকটা অমসৃণ এলোমেলো দুর্গন্ধযুক্ত দাঁত। শতবার বলা সত্ত্বেও সে নিয়মিত দাঁত মাজতে পারে না, সে বলে, মনে থাকে না। সে বলল, তোকে তো আমি খুঁজছিলাম মনে মনে। আমি বললাম, মনে মনে খুঁজে জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে আছিস? সে বলল, সমস্যাটা মারাত্মক, বুঝলি। মাহবুব নামে শ’ খানেক কবি আছে, তো আমাকে মানুষ আলাদা করে চিনবে কি করে? তাছাড়া জাতিস্মর পত্রিকার সম্পাদক, মানে রুদ্রদা বলেছে এরকম নাম কবিদের মানায় না, কবির নাম হবে স্মার্ট। তোর তো বাপ তোকে ভালো নাম রেখেছে রে। আমি বললাম, সে না হয় রেখেছে, কিন্তু কবি হিসেবে তো আমি পরিচিত হতে চাই না। যদিও আমার নামে দু-একখানা কবিতা ছাপা হয়েছে, ভাবছি আর লিখব না। সে আবার দাঁত বের করে এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলে, তাহলে, তোর নামটা আমাকে দিয়ে দে। আমি বললাম, সে কিরে, কি বলিস, মাথাটাথা ঠিক আছে তো? সে ঘাবড়ে যায়, বলে, তাও তো ঠিক, তোর নাম তো সব জায়গাতে আছে, সার্টিফিকেটেও তো আছে। বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম রে। আমি ওর হাত ধরে নিচে নামালাম। বললাম, হে নবীন কবি, এবার চল, কেয়ার সন্ধানে। সে আমার মুখের দিকে তাকায়, না বোঝার ঔৎসুক্য নিয়ে। আমি খুলে বলি: শোন, তুই না বলেছিলি, তোর একটা বাসা চেনা আছে যেখানে কেয়া ফুল আছে। চল তো এক্ষুনি। সে বলল, সে তো অনেক দূর। আমি বলি, তো কী সমস্যা?
আষাঢ়ের ঘন বারিপাত শুরু হয়েছে কয়েকদিন থেকে। এই প্রথম দেখলাম আষাঢ়ের শুরুতে এ শহরে মেঘ ও বৃষ্টির আনাগোনা, সাধারণত আষাঢ় প্রায় শেষ হয়ে যায় তখন তার দেখ মেলে। মন খারাপ করেই মাহাবুব বলে, চল, যাই, যেতে হবে কুমারপাড়া পার হয়ে ফুদকিপাড়ার কাছে, ওখানে একটা পুরোনো বাড়িতে আমি কেয়া গাছ দেখেছিলাম, যত দূর মনে পড়ে। এখন তো ফোটার কথা, পদ্মার ধারে কদমের গাছও আছে অনেক, পলাশ আছে; অবশ্য পলাশের দিন শেষ বোধহয়। আমরা একটা রিকশা নিয়ে বের হয়ে পড়ি। আকাশে ‘ডমরু গুরু গুরু, ঘন মেঘের ভুরু’। যে কোনো সময় বৃষ্টি হবে, তার প্রস্তুতি চলছে। বাঁধের ধার দিয়ে যেতে যেতে সে যা দেখে তার বর্ণনা দেয়। বাঁধের ঢালের সাথে অনেক ফুলের গাছ, ঔষধি গাছ আর ঘাসের মখমল। হলুদ কৃষ্ণচূড়ার একটা গাছ দেখে মাহবুব বলে, এটা চিনিস? আমি বললাম, না, চিনি না। সব গাছ চিনতে হবে কেনো, আমি কি বিভূতিভূষণ? সে চুপসে গেল। এমনিতে বেচারার মন খারাপ। আমি বললাম, তোর নামের আগে একটা ফুলের নাম যোগ করে দে। ধর পলাশ মাহাবুব, বা শিমুল মাহাবুব, কি স্মার্ট লাগছে না? সে আমার দিকে করুণভাবে তাকাল। মুখে বলল, বলছিস? ভালো হবে? কেউ খ্যাপাবে না তো? আমি বললাম, এদেশে নব্বই ভাগ কবির নাম এভাবেই দেওয়া হয়, তুই দিলে সমস্যা কি?
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছাতা নেই, রিকশাওয়ালাকে হুড তুলে দিতে বলে আরো বিপদে পড়লাম। প্রথমত দুজনের বসার জায়গা হয় না, আর হুডের অবস্থা এমন যে সব বৃষ্টি মাথায় পড়ে। অগত্যা রিকশাওয়ালা ভাইকে বলি, একটু দ্রুত চালান না ভাই, সে পিছন ফিরে তাকাল আমাদের দিকে, আর কত জোরে চালাব, মামা? ফুদকি পাড়ার সেই বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামতে আমরা ভিজে কাক হয়ে গেছি, টাকা মিটিয়ে দিয়ে দাঁড়াই, মাহাবুব পরখ করে দেখে বাড়ি ঠিক আছে কিনা। সে আবার দাঁত বের করে হাসে। আমি বলি, আবার ময়লা দাঁত বের করিস কেন? ও বলে, ভুল হয়ে গেছে রে দোস্ত, আসলে ওই বাড়িটা শিরোইলে, ওখানে লম্বা বড় একটা দিঘি আছে না, ওর পশ্চিম পাশে। আমি তো গত কয়েকদিন ধরে কেয়া ফুল নিয়ে ভুগছি, গুগলে সার্চ দিয়েছি চেনার জন্য। কিন্তু বাস্তবে তো আমার কেয়া ফুল দরকার। সে তো মাহাবুবকে বলা যাবে না। নাতাশাকে নতুন নতুন ফুল দিতে দিতে আমি ফতুর হচ্ছি। সে ফুল নিয়ে কি করে আমি জানি না। শুধু আমাকে অর্ডার করে। দুজন মিলেও অনেক ফুল খুঁজে বের করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে প্রধান ফটকের মামাকে ঘুষ দিয়ে ঢুকে ওকে হৈমন্তী ফুল এনে দিয়েছি, সোনালু দিয়েছি। অলকানন্দা সে চিনত না, চিনিয়েছি, অপরাজিতা চিনিয়েছি; বাগানবিলাস, মাধবীলতা গুলিয়ে ফেলত, ঠিক করে দিয়েছি, মালতিলতার খোঁজ দিয়েছি, রক্তকরবী চিনিয়েছি, শ্বেতকাঞ্চন এনে দিয়েছি বহু কষ্ট করে। এখন সে মেতেছে কেয়া নিয়ে। আমি মাঝে মাঝে ওকে বুঝি না, সে কোথায় কি ফুল বা গাছের নাম শোনে আর আমাকে বলে, এনে দাও, বা নিয়ে যাও। আমি যাই অথবা এনে দিই, সে খুশি হয় এটুকু বুঝি, তবে কেন আমাকে বলে তা বুঝতে পারি না। আমি একদিন বললাম, আচ্ছা, এসব নাম তুমি কোথায় পাও বল তো? সে মৃদু হাসে, বলে, কেনো রবী ঠাকুর, ঠাকুরের গান শোনো, দেখবে, প্রকৃতি ফুল গাছ আর তোমার সংবেদন একাকার হয়ে গেছে। আমি লিখি কবিতা, আর নাতাশা আমাকে এভাবে বলে, যেন ওই কবি। আমি তার এই সংযোগ ও ব্যাখ্যা নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ করলে সে বলে, এই তোমাদের কবিদের সমস্যা, তোমাদের ধারণা জগতের সব বিষয় তোমাদের অধিকারে। তোমাদের বাইরের মানুষ এসব নিয়ে বিস্তর ভাবে, তারাও সংক্রমিত হয়, তোমরা একটু ভান করো বেশি করে। আমাদেরও তো ভান করার দরকার পড়ে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমাদের মতো লিখব, তোমাদেরও ভাত মারব। অবশ্য ভাত মারব বলছি কেনো, কবিতা লিখে তো আর ভাত হয় না। জীবনানন্দ পর্যন্ত পাননি। সে যে আমাকে একটু উত্তেজিত করার জন্যই এসব বলছে তা বুঝি। আমি বললাম, আচ্ছা বুঝলাম, ঠাকুর তোমাকে উসকে দিচ্ছে, কিন্তু সবাইকে তো উসকে দিতে পারে না, তাই না? সে এবার চাপা হাসি দিয়ে মুখ অন্য দিকে নিয়ে যায়। ওর ঘন কালো চুল গ্রীবা ছুঁয়ে পিঠের প্রায় সমস্তটা দখল করে নেয়, চিকন গ্রীবার ননী আশ্রিত ত্বক থেকে বিকেলের আলো নতুন করে দ্যুতি ছড়ায়। আমি ওর বাম হাত ধরে হাঁটতে থাকি, একটা সুবাস পাই নাকে, বেলির মতো নাকি গন্ধরাজের মতো বুঝতে পারি না। সে একটা গান গুনগুন করে গাইতে থাকে, আমি কান পাতলে সে একটু স্বর বাড়ায়: নীল অম্বরঘন পুঞ্জছাঁয়ায় সমবৃত্ত অম্বর, হে গম্ভীর, হে গম্ভীর। আমি বলি, এই গান আমার পছন্দ না। ও বলে, ভালো করে শোনো। আমি বলি, ভালো করে শোনার ইচ্ছে নেই। তুমি বরং ওই গানটা ধরো, আবার এসেছে আষাঢ়, আকাশ ছেয়ে; আসে বৃষ্টির সুবাস, বাতাস বেয়ে। সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নদীর দিকে তাকায়। এতদিনের শুকনো পদ্মায় বেশ জল জমেছে, তবে একে এখনো নদী বলা যায় না। সামনের দিনগুলোতে নদী যৌবন ফিরে পাবে। সে শুরু করে দ্বিতীয় অন্তরা থেকে: ‘এসেছে এসেছে’ এই কথা বলে প্রাণ, ‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান, নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে, আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।’ আমি মেঘের ডাকের সাথে বাতাসের মুখরতাকে মিলিয়ে একটা পদের কথা ভাবতে থাকি। বাঁধানো একটা বেঞ্চে ও বসে পড়ে। আমিও বসি। কদমের একটা ডালে নুইয়ে পড়েছে আমাদের হাতের নাগালে। আমি বলি, এই দেখ কদম তোমাকে ইশারা দিচ্ছে। সে বলল, থাক, আজ আর কদম ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে না। আমি বলি, এই গানটাই তোমার মুড বদলে দিয়েছে, তাই না? সে বলে, তা খানিকটা বলতে পারো। রবীন্দ্রনাথের বর্ষামথিত গানগুলো শুনলে দেখবে তারা তোমাকে গ্রাস করে ফেলছে, তুমি বের হতে পারছ না গানের সংবেদ থেকে। একটা গানে আছে, তুমি তো জানে বোধহয় গানটা: আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে, ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। কি অসাধারণ অনুভূতিক গভীরতা দেখেছ? আমি সত্যি আশ্চর্য হয়ে যাই নাতাশার কথাবার্তা শুনে। আগেও সে কথা বলেছে এই সব বিষয়ে, তবে ওর অনুভবের গভীরতা দিন দিন প্রগাঢ় হচ্ছে। আবার ঘন মেঘ করে আসে, এই মেঘে বৃষ্টি না হয়ে যায় না। আমি বললাম, চল উঠি, সে কোনো কথা বলে না। বরং নদীর ওপর দিয়ে অসীম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে।
জবুথবু ভিজে আছি দুজন। মাহাবুবকে বলি, চল একটা কিছু দিয়ে শরীরটা মুছি আগে। সে বলে, টিস্যু ছাড়া তো উপায় নেই। অগত্যা এক প্যাকেট টিস্যু নিয়ে আরেকটা রিকশায় উঠে পড়লাম। আমরা ফুদকি পাড়ার ভেতর দিয়ে কুমার পাড়ার রাস্তা ধরি; সেখানের একটা মোড়ে প্রাচীন বটবৃক্ষের পাশ দিয়ে গুপ্তা হাউজকে পাশ কাটিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে রিকশা সোজা উত্তর দিকে ছোটে। বৃষ্টি এখন নেই। আবার আসবে তবে কিছুক্ষণ সময় নিশ্চয় দেবে। আমরা দিঘির পাশের বড় বাড়িটার ফটকের কাছে থামলাম। প্রধান ফটক খোলা। বাড়ির গোটা চত্বরটার দিকে একবার ভালো করে চোখ বোলালাম। প্রায় জরাজীর্ণ বাড়ি। গাছপালায় ভর্তি। নারিকেল সুপারি পাম তাল থেকে শুরু করে রাজ্যের সব গাছপালা। মাঝখানে ঘাসের বৃত্তাকার লন। পশ্চিম পাশে বড় দিঘি। তার বাঁধানো ঘাটের এপারে একটা বড় বটল ব্রাশ আমাদের দিকে লাল ফুলের চোখ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে তাকিয়ে আছে। দোতলা বাড়ির নিচতলা থেকে গানের আওয়াজ আসছে। ফটকে কাউকে না পেয়ে আমরা চলে এসেছি বিনা অনুমতিতে। গানের শব্দ শুনে কাছাকাছি গিয়ে দেখি দরজা ভেজানো, জানালা খোলা। হারমোনিয়ামে একটা মেয়ে গান করছে। মাহাবুব কলবেল বাজাতে গেলে আমি ওকে থামলাম। পরিচিত গান তবে লয়টা একটু দ্রুত মনে হচ্ছে। অপূর্ব মনে হচ্ছে গায়কি। আমার জানা গান, তবে এত চমৎকার করে কাছে থেকে কাউকে কখনো এ গান গাইতে শুনিনি। আমি বললাম, গানটা আগে শুনি তারপর বেল বাজানো যাবে। একটা বাচ্চা মেয়ে কৌতূহলবশত আমাদের দেখে গেল। গান মাঝামাঝি অবস্থানে: ‘সবাই দেখি যায় চলে, পিছন-পানে নাহি চেয়ে; উতল রোলে কল্লোলে, পথের গান গেয়ে। শরৎ-মেঘ যায় ভেসে, উধাও হয়ে কত দূরে।’
ওপর থেকে একজন ভদ্রমহিলা, ‘মল্লিকা, মল্লিকা, দেখ তো কারা এলো’ বলে বেশ জোরে বললেন। তবু গান থামছে না। আমরাও তো চাই গান না থামুক। আবার শুরুটা গাইল মেয়েটা: দুয়ার মোর পথপাশে. সদাই তারে খুলে রাখি, কখন তার রথ আসে, ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি।’ মাহাবুব বোধহয় ভুলে গেছে যে আমরা কি কাজে এখানে এসেছি।
আমি ওকে টোকা দিতে ও বেশ জোরে বলল, কি হয়েছে? দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। গায়ক মেয়েটাই বোধহয়, সামনে এসে দাঁড়াল। এসে বলল, কাকে চাচ্ছেন? আমি কোনো কথা বলি না, দেখছি মেয়েটিকে, চেনা চেনা মনে হচ্ছে, হয়ত কোথাও দেখেছি অথবা আমার চোখের ভুল। সাধারণ শ্যামলা রঙের হালকা-পাতলা একটা মেয়ে। বিকেলের বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধতা ওর চোখে মুখে। ডাগর চোখ মেলে আমাদের সাথে কথা বলছে। দিঘিটার ওপারে আকাশে মেঘরাশি মুখ গোমড়া করে আছে, আর এদিকে মেয়েটার চোখে মুখে আষাঢ়ের সবুজ ভেজা আভা। আমি তার পাতলা ঠোঁটের কোণে গানের কথা উচ্চারিত হতে দেখছি। কান পেতে শুনতে পাচ্ছি: দুয়ার মোর পথ-পাশে। মাহাবুব কি বলল, আমি শুনতে পেলাম না। তাকে অনুসরণ করে ঘরে গিয়ে বসলাম। পরিপাটি করে সাজানো ঘরটা। তবে আসবাবের বাহুল্য নেই। একটা প্রাচীন কাঠের দোলক ঘড়ি দেখলাম। রাধাকৃষ্ণের বাঁধানো ছবি একটা। আর গানের নানাপদের যন্ত্রপাতি। মাহাবুবের কথা এখন শুনতে পাচ্ছি: আমরা এসেছি, আপনাদের কেয়া ফুল গাছ দেখতে, আর যদি সম্ভব হয় আমার এই বন্ধুকে কয়েকটা ফুল দেবেন। মেয়েটা স্যাপগ্রিন রঙের একটা কামিজ পরে আছে, তার সাথে সাদা ওড়না বুকে ভাজ করা। সে বলল, ঠিক আছে, সেটা দেখা যাবে। তা আপনারা জানলেন কি করে যে আমাদের বাড়িতে কেয়ার গাছ আছে। মাহাবুব বলল, আমি অনেক আগে একবার আমার এক বন্ধুর সাথে এসেছিলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে মেয়েটার ঝরনার মতো কথা শুনছিলাম, যার কণ্ঠ এত সুন্দর তার গান তো সুন্দর হবেই। মেয়েটা বলল, এক কাপ চা খান, তারপর আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি। বাগান তো দেখার কেউ নেই, সব অযত্নে পড়ে আছে। দিদা মারা যাবার পর আমি একটু দেখাশোনা করি।
চা বিস্কুট খেয়ে আমরা দিঘির ধারে গেলাম। এখনো সূর্য ডোবেনি, বৃষ্টিও নেই। আমরা মল্লিকা নামের মেয়েটাকে অনুসরণ করছি। মাহাবুব কথা চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে বেশ সপ্রতিভ মনে হচ্ছে আজ। অন্য সময় মেয়েদের দেখলে ওর গলা শুকিয়ে যায়। আমি চুপ আছি বলেই হয়ত ও জেগে উঠেছে। মল্লিকাকে আমি চিনি না, দেখিনিও কোনোদিন, তবু মনে হচ্ছে, সে আমার খুব পরিচিত। খুব কাছের। কেন যেন মনে হচ্ছে কথা বলতে পারব না। মাহাবুব বোধহয় আমার অসহায়ত্ব টের পেয়েছে। সে আমাকে কিছু জিজ্ঞ্যেস করছে না।
কেয়ার ঝাড় থেকে মল্লিকা মাহাবুবের হাতে কয়েকটা কেয়াফুল দিল। মাহাবুব নিল হাত পেতে। আমার হিংসে হল। সে বলল, আপনারা ঠিক সময় এসেছেন। ইচ্ছে করলে গাছের চারা নিয়ে যেতে পারেন, এখন অবশ্য নেই। পরে দিতে পারব। আমি প্রথম কথা বললাম, আসব, নিশ্চয় আসব। আমার কেয়া ফুল খুব পছন্দ। কথাগুলো বলার পর নিজের বোকামির জন্য লজ্জা পেলাম। ফটকের কাছে গিয়ে মল্লিকা বলল, ঠিক আছে, আবার নিশ্চয় দেখা হবে। আসবেন আবার। দরজা আগের মতোই খোলা। সন্ধ্যের আগে বোধ হয় বন্ধ করে না। আমরা রাস্তা পার হতেই আবার তুমুল জোরে বৃষ্টি শুরু হল। আমি দেখলাম মল্লিকা ভিজতে ভিজতে বাড়ির ভেতর দিকে যাচ্ছে খুব ধীর গতিতে। সে কিছু মনে করছে না। তার কোনো তাড়া নেই। মনে হল এই বৃষ্টির জন্য সে অপেক্ষা করে ছিল এতক্ষণ। চারপাশের গাছপালায় বৃষ্টির নিনাদ শোনা যাচ্ছে। আষাঢ়ের বৃষ্টি তার সাদা ওড়না আর স্যাপগ্রিন জামাটাকে নতুন ব্যঞ্জনা দিচ্ছে। বৃষ্টিমুখরিত বাতাস মল্লিকাকে মথিত করে দিচ্ছে।
মল্লিকা নামের আষাঢ়ের মতো মেয়েটার দিকে আমরা পলকহীন তাকিয়ে থাকলাম।
[ad_2]
Source link