ডিসকোর্স মূলত ভাষা, জ্ঞান এবং ক্ষমতা সম্পর্ক বোঝার একটি কাঠামো—’argument or exchange of ideas’ অর্থাৎ কোনোকিছুর উপর অধিক আলোচনা যা কথ্য বা লিখিত হতে পারে। ১৬ শতকের শুরুর দিকে সাধারণ ভাষণ বা আলাপ বোঝাতে ডিসকোর্স শব্দটি ব্যবহার হলেও বর্তমানে এর পরিসর ব্যাপক। সহজ করে বললে, কোনো একটি বিষয়ে নির্দিষ্ট ভাষার ব্যবহার হলো সেই বিষয়টির ডিসকোর্স। যেমন: মেডিকেল ডিসকোর্স বলতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভাষা, অঙ্গভঙ্গি এবং লিখিত বা মৌখিক কথোপকথনের মাধ্যমে রোগী, চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ককে বোঝায়। এই যোগাযোগ কেবল চিকিৎসার প্রক্রিয়া নয়, বরং তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা-কাঠামোকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ মেডিকেল ডিসকোর্স যে ক্ষমতা-কাঠামো তৈরি করে—যেখানে রোগীর চেয়ে চিকিৎসকের অবস্থানকে শক্তিশালী করে। যেমন: বাংলাদেশে হতাশা, অশান্তি বা মনোরোগ নিরাময়ের জন্য ধর্মীয় অনুষঙ্গের প্রচলন আছে। কিন্তু দিন দিন আধুনিক চিকিৎসার শরণাপন্ন হচ্ছে মানুষজন অর্থাৎ ধর্মীয় অনুষঙ্গের বদলে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর প্রচলন ঘটেছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় সংস্কৃতিতে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে ঐতিহ্যবাহী নিরাময়ের পদ্ধতি প্রায় উপেক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ মেডিকেল ডিসকোর্সের জন্য এই সার্বিক পরিবর্তন হয়েছে। একইভাবে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকদের ব্যবহৃত ভাষার প্রকারকে ‘একাডেমিক ডিসকোর্স’, নারীবাদ তত্ত্বে ব্যবহৃত ভাষার নির্দিষ্ট ব্যবহারকে ‘নারীবাদী ডিসকোর্স’, সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত ভাষার নির্দিষ্ট রূপকে ‘মিলিটারি ডিসকোর্স’ বলতে পারি।
ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) ডিসকোর্স ধারণাটিকে একদমই ভিন্ন আঙ্গিক ও সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, ডিসকোর্স হলো একটি সিস্টেম বা প্র্যাকটিস, যার মধ্যদিয়ে ‘জ্ঞান’ ও ‘অর্থ’ উৎপন্ন হয়। ‘The Archeology of Knowledge’ গ্রন্থে ফুকো বলছেন, “ডিসকোর্স একটি বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করে। তা নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানতে, বুঝতে ও ধারণা গঠন করতে সাহায্য করে।” ডিসকোর্স যে কেবল কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় সংজ্ঞায়িত করে এমন নয় ব্যাপারটা, আলোচনা সীমাবদ্ধও করে অর্থাৎ সেই বিষয় নিয়ে কী বলা যাবে আর কী বলা যাবে না, তাও নির্দিষ্ট করে দেয়।
‘Lecture the discourse of language’-এ ফুকো বলছেন, ডিসকোর্স ন্যাচারাল বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়, প্রত্যেক ডিসকোর্স ‘জ্ঞান’ ও ‘অর্থ’ নির্মাণ করে। প্রত্যেক ডিসকোর্স তার ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্যে নিহিত থাকে। কিছু বাদ দেওয়া হয়, কিছু বিষয়ের জোর দেওয়া হয়—অর্থাৎ এসবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘power’ বা ‘ক্ষমতা’।
‘ক্ষমতা’ হলো ডিসকোর্স নির্ধারক। কোনটা বিষয় বাদ যাবে, কোনটার উপর জোর দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করে ‘ক্ষমতা’।ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ অনুযায়ী ডিসকোর্স গঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে ‘কলোনিয়াল ডিসকোর্স’ এর কথা বলা যায়—কলোনাইজাররা স্থানীয় সবকিছুকে উপেক্ষা, অবহেলা করে নিজেদের সুপিরিয়র, এডুকেটেড এবং এনলাইটেন্ড হিসাবে উপস্থাপন করে গিয়েছে। আবার উল্টোদিকে পোস্ট-কলোনিয়াল ডিসকোর্সে কলোনিয়ালরা কীভাবে আমাদের শোষিত করেছে, ব্যবহার করেছে তা নিয়ে আলোচনা হয়।
ফুকোর মতে, ডিসকোর্স কোনো কিছু সম্পর্কে পূর্ব বা বিদ্যমান ধারণাকে নতুন করে আবিষ্কার করে না, বরং ক্ষমতা ও জ্ঞানের বিশেষ অনুশীলনের মাধ্যমে তা নির্মিত হয়। ডিসকোর্স আমাদের চিন্তা করার পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে। ফুকো যেমন তার ‘The discourse of Sexuality’ গ্রন্থে বলেছেন, সেক্সচুয়ালিটি নতুন একটি ডিসকোর্স। আমাদের ইচ্ছা, আনন্দ এবং অন্তর্নিহিত সত্তা সম্পর্কে চিন্তা করার পদ্ধতিতে তা মৌলিক পরিবর্তন করেছে। একইভাবে নারীবাদী ডিসকোর্স, পোস্ট-কলোনিয়াল ডিসকোর্স, কলোনিয়াল ডিসকোর্স—এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান, চিন্তার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে।
ডিসকোর্স একক বিবৃতির বদলে কতগুলো বিবৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ তা ধারাবাহিক বক্তব্যের একটি কাঠামো, যা সমাজ ও সংস্কৃতির ধারণা গড়ে তোলে। একে ফুকো ‘ডিসকোর্স ফর্মেশন’ বলেছেন— “পরিবার, কারাগার, হাসপাতাল বা পাগলাগারদের মতো বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডিসকোর্স নির্মিত হয়।”
ডিসকোর্স ভাষার সঙ্গে চিন্তাধারার গভীর সংযোগ স্থাপন করে। ফুকো এ সম্পর্কে বলেন, আমরা ভাষার মাধ্যমে চিন্তা করি এবং আমাদের চিন্তা-কাঠামো ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। ডিসকোর্স কোনো ‘ক্লোজড’ পদ্ধতি নয়, বরং গতিশীল প্রক্রিয়া। এক ডিসকোর্স থেকে অন্য ডিসকোর্স উপাদান গ্রহণ করে নতুন অর্থবোধ তৈরি করে।
ডিসকোর্স, আইডিওলজি ও হেজিমনির পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধা হবে। প্রথমে হয়ত প্রশ্ন আসে আইডিওলজি কী? কর্তৃপক্ষের স্বার্থ অনুযায়ী জনগণের সম্মতি আদায়ের জন্য যে নিত্যনতুন ধারণা তৈরি করা হয় সেটাই আইডিওলজি। অর্থাৎ অথরিটি তাদের নিজেদের স্বার্থ আদায়ে জন্য এমন একপ্রকার ‘ধারণা’ তৈরি করে যা কিনা জনগণ নিজের অজান্তেই মেনে নিবে, চর্চা করবে। ডিসকোর্সের মাধ্যমে এই আইডিওলজি সমাজে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ডিসকোর্সের কথা বলা যায়: ধর্মীয় ডিসকোর্স ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতার ভিত্তিতে আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। সত্য বা মিথ্যা যাচাইয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমরা এই ডিসকোর্স মোতাবেক জীবন পরিচালনার চেষ্টা করি। একইভাবে রাজনৈতিক ডিসকোর্সের মাধ্যমে রাজনৈতিক আইডিওলজি প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ ডিসকোর্সের মাধ্যমে আইডিওলজি প্রচার করে মানুষকে হেজিমনাইজড করে।
ডিসকোর্স ও হেজিমনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীগুলো ডিসকোর্স ব্যবহার করে সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করে। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। যেমন: সরকার বা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস বা সংস্কৃতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট ডিসকোর্স অন্তর্ভুক্ত করে ইতিহাসের একমুখীনতা ও আধিপত্য বিস্তার করে। তেমনি ‘লাক্স ব্যবহার করলেই মানুষ সুন্দর হয়ে যাবে’—এই ডিসকোর্স যখন মিডিয়া প্রচার করে তখন আমরা হেজিমনাইজড হয়ে পড়ি। রাতারাতি ফরসা হব না জেনেও ক্রয় করি।
ডিসকোর্স রাজনীতির হাতিয়ার। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ডিসকোর্স ব্যবহার করে তাদের আদর্শ ও নীতি প্রচার করে।
এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, উপনিবেশিতদের সম্পর্কে একটি বিশেষ ডিসকোর্স তৈরি করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যেমন: সাম্রাজ্যবাদী সাহিত্যগুলোতে উপনিবেশিতদের একরকম ‘পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা মূলত ক্ষমতা এবং নিপীড়নের একটি মাধ্যম ছিল।
অন্যদিকে, রিচার্ড টার্ডিম্যান ‘কাউন্টার ডিসকোর্স’ ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি উনিশ শতকের ফরাসি লেখাসমূহকে বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠিত ডিসকোর্সের ক্ষমতাকে অবহেলা বা বিশেষায়ণের জন্য তা ধ্বংস করার পরিবর্তে প্রকৃতপক্ষে এর পরিবর্তন সাধনের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেন। অর্থাৎ বিদ্যমান ডিসকোর্সকে পুরোপুরি ধ্বংস না করে বরং তা পরিবর্তন ও পুনর্গঠন করার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক লেখাগুলোর মধ্যে প্রতিরোধের যে ধারা দেখা যায়, তা কাউন্টার ডিসকোর্সের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি কাউন্টার হেজিমনি বিদ্যমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে।