আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, কেনিয়ান লেখক ও সমাজ-সমালোচক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। তার জন্ম ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে কেনিয়ার লিমুরু শহরে। শুরুর দিকে ইংরেজিতে লেখালেখি করলেও ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক কারণে কারাবন্দি হওয়ার পর মাতৃভাষা গিকুয়ুতে লেখালেখি করেন।
প্যারিস রিভিউ-এর ‘The Art of Fiction No. 253’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নামওয়ালি সারপেল। প্রকাশিত হয় পত্রিকার ২৪০তম সংখ্যায় (Summer 2022)।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে শুরু করেন? বিশেষ কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা থাকে?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: পরিকল্পনা ছাড়া লিখতে বসি। লিখতে লিখতেই লেখা অগ্রসর হতে থাকে৷ শুরুরদিকে কিছুটা জড়তা থাকলেও যখন মন মতো লেখাটাকে দাঁড় করাতে পারি, তখনই তা-ই পরবর্তী অংশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কোথাও কোনো ছবি দেখলাম বা কাউকে হেঁটে যেতে দেখলাম—এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়াদি থেকেও অনুপ্রাণিত হই। আবার কখনো স্রেফ স্মৃতি থেকেও লেখা আসতে পারে। একবার ঘানার সমাজবিজ্ঞানী কে. এ. বুসিয়ার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, ‘Weep Not, Child’-এর প্রথম লাইনটি আমার মাথায় তখনই আসে। অন্যদিকে ‘Devil on the Cross’ উপন্যাসের ধারণা আসে দক্ষিণ কোরিয়ার কবি কিম চি-হা-এর আখ্যানধর্মী কবিতা ‘Five Bandits’ পড়তে পড়তে। সত্তরের দশকে টোকিও ভ্রমণের সময় তার সাহিত্যকর্মের সাথে আমার পরিচয় হয়, শুনেছিলাম তাকে নাকি লেখালেখির জন্য কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমি কবিতাটি পড়ছি—এখানে এমন একটি দলের কথা বলা হয়েছে, যেখানে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য প্রভাবশালী লোকজন তাদের সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে গর্ব করে৷ আমি তখন কবিতাটি নিজের কাছে রাখি। ১৯৭৬ সালে নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে কবিতাটিকে অন্তর্ভুক্তি করার পর একজন দক্ষিণ কোরিয়ান কূটনীতিক আমার অফিসে এসে বলেন যে কিম চি-হা কতখানি নিকৃষ্ট। তখন তাকে বললাম, দেখুন কেনিয়াতে আমরা লেখকদের কারাগারে রাখি না। এর কিছুদিন পরেই ‘Devil on the Cross’ উপন্যাসের জন্য আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: ক্ষমতা দখলের জন্য নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া উচিত কিনা—এই প্রশ্নটি আপনার উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়ে বলেন?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: আমি ঔপনিবেশিক প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। ১৯৩৮ সালে, আমার জন্মের সময় কেনিয়ার সেনাবাহিনী, বিচার ব্যবস্থাসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ব্রিটিশদের প্রবল আধিপত্য ছিল। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে ‘কেনিয়া ল্যান্ড এন্ড ফ্রিডম আর্মি’ এবং ‘মাউ মাউ’ এর মতো স্বাধীনতাকামী দলগুলো যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা বেশিরভাগই ছিল সাধারণ কৃষক অথবা শ্রমজীবী মানুষ। এদের মধ্যে একজন ছিল আমার ভাই।
আমার বাবার চার স্ত্রী ছিল, অনেক সন্তানসন্ততি নিয়ে যৌথ-পরিবার। একই সাথে বসবাসের ফলে সকলের প্রতিই সকলের গভীর হৃদ্যতা কাজ করত। তবে আমাদের মাঝে রাজনৈতিকভাবে মতভেদ ছিল। গুড ওয়ালেস (নগুগির বড় ভাই) তখন পাহাড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল এবং আমার সৎভাই টুম্বো তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিল। এক রাতে তারা দুজনেই আমার আরেক ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য মনঃস্থির করে, সে ভাইটি কাজ করতো একটি জুতার কারখানায়। হঠাৎ করে দরজায় তাদের মুখোমুখি দেখা হলে দুজনেই উল্টোদিকে দৌঁড়াতে শুরু করে। একজন পালাচ্ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে, অন্যজন ভেবেছিল ‘মাউ মাউ’ বিপ্লবীরা তাকে হয়ত মেরে ফেলবে। মূলত এমন প্রতিদ্বন্দ্বীতার মধ্যেইউ আমার বেড়ে ওঠা, সেজন্যেই হয়ত কুস্তির প্রতি আমার ভীষণ আকর্ষণ।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কখন আপনার সাহিত্যকর্মে নিজের যাপিত জীবন এবং কেনিয়ান ল্যান্ড অ্যান্ড ফ্রিডম আর্মির রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: কাম্পালায় মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। তখনই মূলত লেখালেখি শুরু করি। নাইরোবিতে তখন আফ্রিকানদের সাথে বিদেশিদের মতো আচরণ করা হতো। আমার ঠিক মনে আছে, কাম্পালায় পৌঁছে অবাক হয়ে খেয়াল করি যে এই শহরের আনাচে কানাচে আফ্রিকান মানুষে ভরা—তবে এরা কখনো কেউ নিগ্রহের শিকার হয়নি। আমি যে মানসিক যাতনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা মাকেরেরেতে আসার আগে বুঝে উঠতে পারিনি। মাকেরেরে সেই সব মুহূর্তগুলো দিয়েছে—যেখানে আমি চিন্তা করতে পেরেছি আমার সাথে কী কী ঘটেছিল।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আমি পড়েছি যে সান ফ্রান্সিসকোতে একটি হোটেলে বসে থাকার জন্য আপনাকে হয়রানি করা হয়েছিল।
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: হ্যাঁ। ‘Wizard of the Crow’ বইয়ে বুক-ট্যুরে প্রকাশক খুব সুন্দর একটি হোটেলে আমাকে নিয়ে ওঠলেন। প্রাতরাশের আগে ডাইনিং এরিয়াতে বসে পত্রিকা পড়ছি এমন সময় সুন্দর পোশাক পরা একজন যুবক এসে বেশ ভদ্রভাবে বলল, “এই জায়গা হোটেলের অতিথিদের জন্য, দয়া করে এখান থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে।” সে আমার সাথে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, তবে তার কণ্ঠে একধরনের নিশ্চয়তার ভাব ছিল যে এখানে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না—এই বিষয়টি আমার পরিষ্কার মনে আছে। কেউ আমাকে গালিগালাজ করলেও হয়ত এরচেয়ে কম ভয় পেতাম। পরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে পরিস্থিতি যদি ভিন্ন হতো এবং এই লোকটির হাতে যদি বন্দুক জাতীয় কিছু থাকতো, তবে সে আমাকে এই নিশ্চয়তার সাথেই গুলি করে দিত।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনার উপন্যাসের খসড়া কাউকে পড়তে দেন?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: ইদানীং সন্তানদের সামনে জোরে জোরে লেখা পড়ার চেষ্টা করি, যদিও তারা সবসময় শুনতে চায় না। প্রকাশের আগে সাধারণত আমার লেখা কারও সাথে শেয়ার করি না, তবে ১৯৬২ সালে চিনুয়া আচেবেকে ‘Weep Not, Child’ বইয়ের খসড়া দেখিয়েছিলাম। তখন তিনি আমার ক্লাসে এসেছিলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘African Writers of English Expression’ কনফারেন্সে তার সাথে দেখা করি। মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে তিনি কিছু জায়গায় মার্ক করে রেখে বললেন, “মৃত ঘোড়াকে চাবুক মারবে না” অর্থাৎ বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমার বক্তব্যের প্রতি আমি অতিরিক্ত জোর দেয়ার চেষ্টা করছি। তার এই পরামর্শ তখন বেশ কাজে দিয়েছিল। তার প্রকাশক হাইনেম্যানকে তিনি আমার পান্ডুলিপি দেখিয়েছিলেন, যিনি পরে উপন্যাসটি প্রকাশ করেন।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কারাগারে থাকাকালীন গিকুয়ু ভাষায় উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: ১৯৭৭ সালে গিকুয়ু ভাষায় রচিত ‘I Will Marry When I Want’ নামের একটি নাটক লেখার জন্য আমাকে কারাবরণ করতে হয়৷ ইতোপূর্বে ইংরেজিতে নাটক লেখার জন্যে জেরা করা হলেও কারারুদ্ধ করা হয়নি কখনো। ভাষার বিষয়টি তখন থেকেই আমার চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। যদিও তখনকার আফ্রিকান সরকারের রাষ্ট্রপতি নিজেও গিকুয়ু ভাষার ভালো বক্তা ছিলেন—তবুও আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়। ‘Devil on the Cross’ লেখার সময় এসব চিন্তাভাবনায় আমাকে প্রচণ্ড বিচলিত করতে থাকে।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: নাটকের বিষয়বস্তুর চেয়ে, বরং ভাষায় সরকারকে বেশি ক্ষুব্ধ করেছে—আপনার কাছে এমন মনে হয়েছে?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: প্রান্তিক পর্যায়ে নাটক মঞ্চায়ন করার প্রয়াসের ফলে ভেবেছিলাম আমাকে প্রশংসিত করা হবে। ‘কামিরিথু কমিউনিটি এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’ শুরু থেকেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল৷ অভিনেতারা সেই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষজন ছিল। এমনকি এরা নাটকের দৃশ্য সংশোধনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। আমরা চেয়েছিলাম, ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোর জ্ঞান ও দক্ষতার বিভ্রান্তির অবসান হোক এবং প্রান্তিক জনমানুষের অভিনয় করার ঐতিহ্যকে যেন মূল্যায়ন করা হয়। এমনটা করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই আমাকে প্রান্তিক জনমানুষের ভাষাকেই ব্যবহার করতে হয়েছিল।
এই নাটকের কারণে কারাবরণের বিষয়টি তখন একটু দ্বিধায় ফেলে দেয়, কারণ এরথেকে আমার অন্যান্য নাটকে আরও স্পষ্টভাবে আমি ঔপনিবেশিক শাসনের সমালোচনা করেছি। ‘Petals of Blood’ উপন্যাসের কথা বাদই দিলাম, এই উপন্যাসে আরও বিশদভাবে ঔপনিবেশিকতার সমালোচনা করেছিলাম। নাটকটিতে যা করতে পারিনি, তাই করতে চাচ্ছিলাম ‘Devil on the Cross’ উপন্যাসে। মনে হচ্ছিল নিজেকে যেন বলছি, এই কারাগারে সেই কাজই করব—যা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমাকে তখন রাতদিন কড়া পাহাড়ায় রাখা হচ্ছে। ওয়ার্ডেনদের কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে তবুও এই উপন্যাসটি লিখে ফেলি। আমার লেখালেখি দেখে তারা মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে যেতো—আমাকে কি লেখার জন্যেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে নাকি অন্যকোনো কারণ আছে। বাহিরের কোনো খবর আমাকে বলা নিষেধ ছিল, তাই আমি তাদের গিকুয়ু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। মজার বিষয় হলো, এদের মধ্যে কেউ কেউ তখন আমার গিকুয়ু শিক্ষক হয়ে ওঠেছিল।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: গ্লোবালেক্টিক্সে ‘Poor Theory’ নামের একটি তত্ত্বের ধারণা আপনি দিয়েছিলেন, যেখানে স্বল্প রসদ দিয়ে কোনোকিছু সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে৷ স্যামুয়েল বেকেট মনে করতেন যে প্রথমে ফরাসি ভাষায় লেখা এবং তারপরে সেটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার মধ্যে একপ্রকার সীমাবদ্ধতা কাজ করে৷ গিকুয়ুতে লেখার ক্ষেত্রে আপনারও কি একই ধারণা?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: বেকেটের উচিত ছিল আইরিশ ভাষায় লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া! গিকুয়ুতে লেখা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং, ঠিকমতো প্রকাশক পাওয়া যায় না। এমনকি কেনিয়াতেও না। বিদ্যালয়, বই অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষার দখল ছিল। ১৯৫২ সালের আগে ব্রিটিশরা আফ্রিকান মিডিয়ামের সকল বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার পূর্বে বই বা লিফলেট গিকুয়ুতে লেখা হলেও সংখ্যায় তা ছিল বেশ অল্প। কেনিয়ার সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবীরা ধীরে ধীরে ইংরেজির দখলে চলে যায়। আমার উপন্যাসের মাধ্যমে আমি এমন কিছু করতে চাচ্ছিলাম যা গিকুয়ুতে এর আগে কখনও করা হয়নি। আমার বইগুলোকে তাই একটি ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেখা হয়।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: বিউপনিবেশায়ন আন্দোলন পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে হলিউডে, সাংবাদিকতায়, প্রকাশনায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ বিষয় আপনার মন্তব্য কী?
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: ‘Decolonizing the Mind’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে আফ্রিকার কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছিল। একজন বলেছিল, “ নগুগি আমাদের রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে বলছেন।” তখন মনে হয়েছিল তিনি হয়ত অসাবধানতা বশত নিজ ভাষার পশ্চাৎপদতাকে বোঝাতে চেয়েছেন। যদিও আমি ভুল ছিলাম। আরেকবার লন্ডনে এক সম্মেলনে বইটি নিয়ে আলোচনার সময় কেউ একজন জুলু ভাষায় আমাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছিল—তিনি ভাষাটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করছিলেন যেনো তা হাস্যকর কোনো কিছু।
পরবর্তী সময়ে আমি ব্লেকের “To see a World in a Grain of Sand” বাক্যটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। বাক্যটি ‘গ্লোবালেক্টিক্সে’ আমার ধারণার সারসংক্ষেপ। আপনি যখন নিজ অভিজ্ঞতাকে বালির দানা হিসেবে দেখবেন, তখন দানার মধ্যদিয়েই পুরো বিশ্বকে দেখতে পাবেন। সেই দানা হতে পারে আপনার নিজস্ব ইতিহাস অথবা আপনার নিজস্ব ভাষা—তা ইংরেজিই হোক বা কিসোয়াহিলি। একটি ভাষাকে অন্য ভাষার ওপরে স্থান দেয়ার যে শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা, আমি সেই ব্যবস্থাকে ঘৃণা করি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ঔপনিবেশিক প্রভাব বিলুপ্তির ব্যাপারে আগ্রহী। ১৯৬৮ সালে নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ বিলুপ্তির আহ্বানে আপনি অংশ নিয়েছিলেন।
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো: এক অর্থে ১৯৬৮ সালে নাইরোবিতে উত্তর-ঔপনিবেশিক আর উপনিবেশ তত্ত্বের সূত্রপাত। আমি এবং আমার সহকর্মীরা তখন নাইজেরিয়ান ইতিহাসবিদ কেনেথ ডাইক এবং কেনিয়ার ইতিহাসবিদ বেথওয়েল ওগোটের দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলাম। তারা ইতিহাসের মৌখিক অংশকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। আমদের তখন প্রধান প্রশ্নটিই ছিল, আপনি যদি কেনিয়ায় থাকেন তবে আপনার অভিজ্ঞতার কেন্দ্র লন্ডনের পরিবর্তে নাইরোবি হওয়া উচিত নয় কি? কিছু লোক তখন আমাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল, কারণ আমরা ইংরেজি কোর্সের মূলনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলাম। কেনিয়ার সংসদ তখন বলেছিল যে আমরা শেক্সপিয়ারকে বাদ দিতে চাচ্ছি এবং এর পরিবর্তে ক্যারিবিয়ান কমিউনিস্টদের আনার চেষ্টা করছি। ভি.এস. নাইপলকে কমিউনিস্ট ভাবার বিষয়টি খুবই হাস্যকর ছিল।
কারাগারে যাওয়ার আগে থেকেই ভাষা নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা জারি ছিল। তবে ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে ‘PEN ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস’-এ যোগ দেয়ার পর মূলত এর সূচনা হয়। সেখানে আর্থার মিলারের সভাপতিত্বে একটি প্যানেলে পাবলো নেরুদা এবং ইগনাজি সিলোন অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেখানে এক বক্তৃতায় ইগনাজি সমসাময়িক ইতালীয় উপন্যাসের অল্প সংখ্যক ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে আফসোস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ইতালীয় ভাষা কোনো বান্টু (আফ্রিকান একটি ভাষা) এর মতো ভাষা নয়, যার শব্দভাণ্ডারে মাত্র এক-দুইটা শব্দ আছে।” তখন আমি দাঁড়িয়ে তাকে সংশোধন করি। আমি প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে লীডসে ফিরে আসি। তখন ‘A Grain of Wheat’ উপন্যাসের অর্ধেক শেষ করেছি। আমার মনে হলো, ইংরেজিতে লিখে হয়ত ইগনাজির কথার স্বপক্ষেই আমি অবস্থান করছি। এই দ্বন্দ্বই আমার অভ্যন্তরে ভাষা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করে।