Homeসাহিত্যনগুগির সঙ্গে এক বিকেলে

নগুগির সঙ্গে এক বিকেলে


বর্তমান বিশ্বের একজন প্রধান লেখক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন সেটা জানতাম। কিন্তু তিনি যে খোদ নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়েরই তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেন, সে-খবর জেনেছি কিছুকাল আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্র বন্ধুবর সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় ও সালেক খান ভাইয়ের কাছ থেকে। তারা দুজনেই তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র ও দুজনেই সমান অভিভূত তাঁর স্নেহ-সান্নিধ্যে। সেই খবর পাওয়া অব্দিই তাঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠেছিল আমার। আমি নিজেও তাঁর একজন গুণগ্রাহী পাঠক। তাঁর ওপর ছোট্ট একখানা নিবন্ধ ও তার উপন্যাস ‘Weep Not Child’ এর আলোচনা লিখেছি আমি কয়েকবছর আগেই। গেলবছর আমার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘দ্বাদশ কাহিনি’-এর একটি গল্প হিসেবেও নির্বাচন করেছিলাম তাঁর অসাধারণ ছোটগল্প ‘Minutes of Glory’। সেই গল্পের অনুবাদবিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একবার কিছুক্ষণের জন্যে টেলিফোনে কথাও হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। কিন্তু একেবারে সামনাসামনি দেখা ও মুখোমুখি বসে আলাপ হলো সম্প্রতি এক হিমেল সন্ধ্যায়, গ্রিনিচ ভিলেজের একটি রেস্তোরাঁয়।

নিউইয়র্ক ভিত্তিক বাংলাদেশি নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কলের কর্ণধার মুজিব বিন হক অনেকদিন ধরেই তাঁর দলের জন্য একটি বিদেশি নাটক অনুবাদ করে দেবার অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন। এ নাটক, সে নাটক পড়ে শেষপর্যন্ত আমি মনস্থির করি প্রিয় লেখক নগুগির বহু বিখ্যাত ও একইসঙ্গে বিতর্কিত নাটক ‘I Will Marry When I Want’ অনুবাদ করব। সুদীপ্তর কাছ থেকে বইটা ধার করে এনে এক বসায় পড়ে ফেলি এবং বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে তার আশ্চর্য সাদৃশ্য ও প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেয়ে তৎক্ষণাৎ তা তর্জমা করার সিদ্ধান্ত নিই। বেশ কিছুদিন খেটে ‘শরিয়তি শাদি’ নামে তার প্রাথমিক খসড়াও তৈরি করে ফেলি। মুজিব বিন হক ভাই কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন নাটকটির মহড়ার কাজে। তখনই মনে পড়ল, নগুগি যখন এই শহরেই আছেন তখন তাঁর কাছ থেকে কেনিয়ায় এ নাটকের মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কিছু জেনে আসি না কেন? জানা ছিল, ইংরেজি ভাষায় আর সাহিত্যচর্চা না করার সিদ্ধান্ত নেবার পর মাতৃভাষা গিকুয়ুতে লেখা এটিই প্রথম রচনা নগুগির এবং এ নাটকটি তিনি তাঁর গ্রামে, খোলা আকাশের নিচে সম্পূর্ণ অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে মঞ্চায়ন করেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘Peasant’s Theater’। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই নাটক। কিন্তু এর রাজনৈতিক বক্তব্য ও প্রতিবাদী স্বরে ভীত হয়ে শাসকশ্রেণি নাটকটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নাট্যকার নগুগিকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে। সেটি ১৯৮৩ সালের কথা। সেই থেকে দীর্ঘ ১২ বছর নগুগি নির্বাসিতের জীবনযাপন করছেন এদেশে-ওদেশে। নাটকটির বাংলাভাষার নিউইয়র্ক মঞ্চায়ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন।

কথামতো, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে, নগুগির ক্লাসঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম আমি বিকেল থেকেই। নগুগি সেখানে ‘Performance Theory’ পড়ান। জনপ্রিয় শিক্ষক তিনি ছাত্রছাত্রীদের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে ক্লাস থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল। করমর্দনশেষে তিনিই প্রস্তাব দিলেন কোনো কফিখানায় গিয়ে বসতে। আমাদের সঙ্গে তাঁর সাহায্যকারী সিয়েরা লিওনের চৌকস যুবক মোস্তফাও ছিল। তিনজনে মিলে খাস নিউইয়র্কারের ভঙ্গিমায় কফি ও ব্যাগেল নিয়ে আমরা অতঃপর গল্পে মাতি। আমি সরাসরি নাটকের প্রসঙ্গে চলে যাই। নগুগিও তাতে সাগ্রহে সাড়া দেন। মুহূর্তে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে তাঁর চোখমুখ। তিনি মোস্তফার কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে তাতে এঁকে দেখাতে লাগলেন নাটকের মঞ্চ ও আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহ। সেই সঙ্গে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন আমার ছোট ছোট প্রশ্নসমূহের। অপেশাদার অভিনেতাদের সাফল্যের কথায় তাঁকে রীতিমতো উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। নাটকের দক্ষিণা ছিল যৎসামান্য; যেন গ্রামের সাধারণ মানুষজন তা দেখতে পারে, কিন্তু মোড়লশ্রেণিকে বেশি দাম দিতে বাধ্য করেছিলেন তাঁরা, এই কথা বলে শিশুর সারল্যে হাসেন নগুগি। নাটকের পটভূমি হিসেবে উল্লেখ করলেন, বিদেশি ধর্মপ্রচারকশ্রেণি ও স্থানীয় বহুজাতিক সংস্থা ‘বাটা’ কোম্পানির অনৈতিক ও ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপই তিনি এই নাটক রচনা করেন। আর এ কারণেই তাদের অনাচারের প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী, খেটেখাওয়া গ্রামবাসীরা এমন বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছিল নাটকটির মঞ্চায়নে। এ প্রসঙ্গে মোস্তফা সম্প্রতি নাইজেরিয়ায় শাসকশ্রেণির হাতে নিহত লেখক ও পরিবেশকর্মী কেন্ সারিউইয়া ও শেল কোম্পানির সঙ্গে তার সাদৃশ্যের ইঙ্গিত করলে নগুগি প্রবলভাবে মাথা দুলিয়ে বললেন, দুটো ঘটনার চরিত্রই হুবহু এক। শুধু তফাৎ একদিকে বাটা কোম্পানি ও অন্যদিকে শেল কোম্পানি। আর কেন্ সারিউইয়া প্রতিবাদ করতে গিয়ে ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তিনি নিজে ভাগ্যক্রমে প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছেন বিদেশে। এ ঘটনার বর্ণনায় নগুগিকে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে খুবই ক্ষুব্ধ মনে হলো। বিশ্ব পুঁজিবাদের নগ্ন ও নির্মম আচরণ বিষয়ে তিনি আমাদের সতর্ক করে দিলেন এবং বললেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো বইখানা আরেকবার পড়ে দেখতে। তাঁর মতে, বর্তমান সময়ের চেয়ে বইখানা আর কোনদিনই বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল না ।

মাতৃভাষা গিকুয়ুতে লেখার বিষয়টা নিয়ে কথা তুলি আমি। বলি কিছুদিন আগে এই নিউইয়র্কেই চিনুয়া আচেবের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার আলোচনার কথা। চিনুয়া, সোয়েঙ্কা প্রমুখ ইংরেজিতেই লেখার পক্ষপাতী, মূলত বৃহত্তর পাঠকশ্রেণির বিবেচনাতেই। কিন্তু কট্টর দেশপ্রেমী ও মাতৃভাষার অনুরাগী নগুগি মনে করেন, আফ্রিকান ও অন্যান্য স্বল্পপরিচিত দেশ ও ভাষার লেখকদের এই প্রলোভন উপেক্ষা করে মাতৃভাষাতেই লেখা উচিত, কেননা তাদের প্রথম ও প্রধান দায় স্বদেশের জনগোষ্ঠীর প্রতি। এতে পাঠকসংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তিনি মনে করেন বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নেওয়া ভালো। অবশ্য তিনি এও মনে করেন যে, কোনো ভালো লেখারই প্রচার আটকে থাকে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি তাঁর আলোচ্য নাটকটির কথাই বললেন। এর মঞ্চায়ন তিনি দেখেছেন ফরাসি, জার্মান ও সুইডিশ ভাষায় এবং অচিরেই বাংলা ভাষায় তার মঞ্চায়ন দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সেটাও জানাতে ভুল করলেন না। আমি কৃতার্থ বোধ করলাম। ইতোমধ্যে ঘণ্টা দুয়েক গড়িয়ে গেছে। ওয়েট্রেস বিল রেখে গেছেন অনেক আগেই। আমরা কথা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াই। আমি তাঁকে আমার সম্পাদিত সমকালীন বিশ্বগল্পের সংকলন ‘দ্বাদশ কাহিনি’ বইটির একটি কপি উপহার দিই। তিনি বাংলাভাষায় অনূদিত তাঁর লেখার প্রথম নিদর্শনটি দেখতে পেয়ে স্পষ্টতই খুশি হন। ধন্যবাদ জানান বারবার করে। তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাতের উষ্ণতাটুকু আমার করতলে গেঁথে নিয়ে আমি বাড়ি ফিরি গভীর তৃপ্তিতে।

নিউইয়র্ক
১৯৯৫





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত