Homeসাহিত্যনববর্ষ সাংস্কৃতিক উৎসব : মোস্তফা তারিকুল আহসান

নববর্ষ সাংস্কৃতিক উৎসব : মোস্তফা তারিকুল আহসান

[ad_1]

মোস্তফা তারিকুল আহসান কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি দুই দশকের অধিক সময় ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। ফোকলোরের নানা বিষয়ে গবেষণা ও ফিল্ডওয়ার্ক করেছেন। ফোকলোর নিয়ে তার অসংখ্য গবেষণা-পুস্তক ও নিবন্ধ বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দেশে বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একাডেমিয়া ও গুগল স্কলার। আমেরিকান ফোকলোর সোসাইটির সদস্য। ফোকলোর গবেষণা পত্রিকা ‘ব্রাত্য’-র সম্পাদক।

বাংলা ট্রিবিউন: পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন কি মুঘল আমলে বাংলা সন চালুর সাথে সম্পর্কিত, নাকি এর প্রাচীনত্ব আরও বেশি?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ব্যাপকভাবে উদ্‌যাপনের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। মূলত আশির দশকের শেষের দিকে বড় আকারে উদ্‌যাপনের কারণে এ নিয়ে, এর ইতিহাস ও নানাবিধ সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ বিশেষত ফোকলোর বিশেষজ্ঞগণ বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তারা প্রতি বছর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রবন্ধ এবং কিছু বইপত্রও লেখেন। এর আগে অবশ্য বাংলা সন নিয়ে বেশ গবেষণামূলক কাজ হয়েছিল।
বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, সম্রাট আকবর ষোড়শ শতকে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে হিজরি সনের পরিবর্তে বাংলা সন চালু করেন। তবে পহেলা বৈশাখ সে সময় এভাবে পালিত হত না। খাজনা আদায় ফসল তোলার সঙ্গে যুক্ত ছিল, আর এর সাথে বছরের প্রথম দিনকে বেছে নেওয়া হতো, যা চন্দ্র বা সূর্যকেন্দ্রিক গণনার পরিবর্তে বাংলা অঞ্চলের ফসল তোলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। আকবরের দরবারের পণ্ডিতেরা এটা ঠিক করেছিলেন। দুএকজন অবশ্য রাজা শশাঙ্ককে এই কাজের প্রবর্তক মনে করেন, যা সমর্থনযোগ্য নয়। সেই হিসেবে পহেলা বৈশাখের প্রাচীনত্ব বেশি দাবি করা হলেও তা প্রামাণিক নয়।

বাংলা ট্রিবিউন: চারুকলা ইনস্টিটিউট উদযাপ‌নের কার‌ণে কি এই উৎস‌বের রাজনী‌তিকরণ হ‌য়ে‌ছে?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: কোনো উৎসবই তার প্রাথমিক অবস্থায় থাকে না, কারা এটা শুরু করল, কারা এর নেতৃত্ব দিল তারও ঠিক থাকে না। অবিরাম পরিবর্তনের মাধ্যমে এর চেহারা ও উদ্‌যাপন পাল্টে যেতে থাকে। নববর্ষে শোভাযাত্রাই একমাত্র অনুষঙ্গ নয়। ছায়ানট, রমনার বটমূলে ভোরে যে সমবেত গান দিয়ে এর অভিষেক পর্ব শুরু করে, বাংলা একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমি যেসব লোকজ উৎসবের আয়োজন করে (যাত্রা, পালা, পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ, লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান) সবই এর অংশ। আনন্দ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা আয়োজন করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এতে যোগ দেয়। পুরান ঢাকার লোকজন একসময় র‌্যালি বের করত। এখন মূল র‌্যালি চারুকলার নেতৃত্বে হয়ে থাকে। এর সঙ্গে রাজনীতির তেমন যোগ নেই। চারুকলার ছাত্ররাই মূলত নানা রকম ছবি ফেস্টুন বা এক একটা থিম নিয়ে প্রতিকৃতি তৈরি করে। এসব মূল আর্ট থেকে আলাদা। এটা ফোক আর্ট। নানা ধর্মের বর্ণের সম্প্রদায়ের দেশি বিদেশি অজস্র মানুষ এখানে যোগ দেয় বলে কোনো রাজনৈতিক দল একে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। তবে আমাদের কাছে এরকম কোনো তথ্য নেই যে, এভাবে সরাসরি একে কেউ রাজনৈতিকভাবে যুক্ত করার চেষ্টা করেছে। চারুকলা অনুষদ করে বলেই এটা তাদের অধিকারে আছে। ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে।

বাংলা ট্রিবিউন: পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন কি বা‌ণি‌জ্যিক ও রাজ‌নৈ‌তিক হ‌য়ে উঠ‌ছে?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: পহেলা বৈশাখ একই সঙ্গে আমাদের প্রধান লোকজ ও জাতীয় উৎসব। এত মানুষ বিপুলভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এর একটা বড় অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে। পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের জন্য এখন সরকার ভাতা দিয়ে থাকে, বিশেষ খাবাবের চাহিদা বাড়ে, অনেক জায়গায় বিশাল মেলা বসে, বিশেষ ধরনের পোশাক প্রচুর বিক্রি হয়। বড় বড় ব্রান্ডের পোশাক কোম্পানি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। সিনেমা টিভি বা বিনোদন জগতেও এর প্রভাব পড়ে। তবে এটা সার্বজনীন উৎসব। কিছু কূপমণ্ডূক ছাড়া প্রায় সবাই এতে মিলিত হয়। এই উৎসবের আনন্দ উন্মাদনার পর্যায়ে চলে যায়। তবে এটা কোনোভাবে রাজনৈতিক উৎসব নয়। বর্তমান সরকারও সবার অংশগ্রহণে এটা পালনের উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: পহেলা বৈশাখ কি সনাতনী তথা হিন্দু ধর্মীয় উৎসব? ইসলা‌মের স‌ঙ্গে এর নৈকট‌্য ও দূরত্ব কতটুকু?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: লেভি স্ট্র্রস সংস্কৃতির সর্বশেষ সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা যা অর্জন করি তাই আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের বলতে কষ্ট হয় একটা ভাষাভিত্তিক জাতীয়বাদের দেশে স্বাধীনতার পাঁচদশক পরও সংস্কৃতির পাঠ নিয়ে আমরা অর্থহীন তর্ক করছি। যা অজ্ঞনতার শামিল। সংস্কৃতিবান জাতি এক সময় সভ্য জাতি হয়ে ওঠে। আমরা ভুল পথে যাচ্ছি বলে মনে হয়। আমাদের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক ধারণার অজ্ঞতার কারণে আমরা অবান্তর সব কথা বলছি। সংস্কৃতি সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান; এর চেয়ে মানুষের জীবনে বড় আর কিছু হতে পারে না। ধর্ম হলো সংস্কৃতির অংশ। প্রতিটি ধর্মের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি; ধর্মের বিবেচনায় আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ বা খ্রীস্টান। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশি। জাতীয়তা ও নাগরিকতা এক নয়। কোনো কোনো দেশে এক হতে পারে। আমাদের বেলায় সেটা ঠিক হতে পারে না। হিন্দু-মুসলিম এদেশে হাজার বছর ধরে এক সাথে বাস করেছে। কোনো সমস্যা অন্তত ইংরেজরা আসার আগে হয়নি। সেই শিক্ষা-সহবত আমাদের ছিল। এদেশে এখনো পাশাপাশি মসজিদ মন্দিরে মানুষ প্রার্থনা করে। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা মুসলিম সেটা যেমন সত্য তেমনি আমরা বাঙালি সেটাও সত্য।’ বাঙালি সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি এ কথা মোটেও ঠিক নয়। দীর্ঘ দিন ধরে এ অঞ্চলের মানুষ পাশাপাশি বাস করে বাঙালি সংস্কৃতি তৈরি করেছে। আর যারা মুসলিম হয়েছে তারা এই সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে। আরবের মুসলিমদের ধর্ম ইসলাম তবে সংস্কৃতি আলাদা। পারস্যের মুসলিমদের সংস্কৃতি আলাদা। তেমনি আমাদের সংস্কৃতি বাঙালি, আমাদের ধর্ম ইসলাম বা হিন্দু। মানুষ কখনো তার ধর্ম ত্যাগ করতে পারে, তবে তার সংস্কৃতি ত্যাগ করতে পারে না। কারণ জন্ম থেকে সে যে সমাজ ও সংস্কৃতিতে বড় হয়ে ওঠে তার সাথে তার নিবিড় অন্বিষ্টতা তৈরি হয়। নানা আচার-আচরণ কাজ কর্ম বিশ্বাস শিল্প-সাহিত্য মিলে তার মানস গঠিত হয়। তা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। মুসলিমরা কোনো দ্বিধা ছাড়াই নববর্ষের উৎসবে যোগ দেয়, কারণ এটা কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়। আর ইসলাম ধর্মের সাথে এর যোগ নেই, কারণ এটা ধর্মীয় কোনো উৎসব নয়, এটা সাংস্কৃতিক উৎসব।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলা নববর্ষ উদযাপনে গ্রামীণ ও শহুরে সমাজের রূপান্তর কীভাবে ঘটেছে?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: বাংলা নববর্ষ এখন যেভাবে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে উদ্‌যাপিত হয় তা আগে হতো না। এটা আশির দশকে ঢাকা থেকে উদ্‌যাপিত হতে হতে অন্য নগর থেকে গ্রামের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এখন মিডিয়ার কারণে গ্রামের মানুষও সংশ্লিষ্ট হতে শুরু করেছে। যদিও অধিকাংশ গ্রামীণ সংস্কৃতি বা উৎসব গ্রাম থেকে শহরের দিকে প্রসার লাভ করে, এখানে হয়েছে খানিকটা উলটা। তবে এখন গ্রামে ‘হালখাতা’ই নববর্ষের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। তার সাথে চৈত্রসংক্রান্তির কথাও মনে রাখতে হবে। গ্রামের কৃষক বা অন্য পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বাংলা মাসের নাম-ধাম বা বৈশিষ্ট্য জানে। পহেলা বৈশাখে গ্রামের ব্যবসায়ী বা কারবারিরা যে আয়োজন করে তা কোনোভাবে বৈশাখের উদ্‌যাপনের সঙ্গে তুলনীয় নয়, তবে অন্বিষ্টতা আছে।
সংস্কৃতির শক্তি ব্যাপক এবং বৈশাখের যে উদ্দীপনা, বা আয়োজনের যে সমগ্রতা যা সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই কারণেই শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যাপকভাবে রূপান্তর ঘটেছে। বৈশাখ আমাদের সামগ্রিক জীবনাচরনে গভীরভাবে নানা পরিবর্তন সূচিত করেছে। এটা এখন সার্বজনীন উৎসব;  নতুন পোশাক পরা, খাওয়া-দাওয়া, মেলা, আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসবের ভেতর দিয়ে এটা  গ্রামীণ ও শহর জীবনের নতুন এক সাংস্কৃতিক চেতনা ও ধারার  জন্ম দিয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: গ্রাম বাংলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনে গাজনের মেলা, বাউল গান ইত‌্যা‌দি আ‌য়োজনের প্রবণতা কি সংকু‌চিত হ‌য়ে আসছে?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: সংস্কৃতির রূপান্তর ও পরিবর্তন ঘটে। এটা খুব স্বাভাবিক ও প্রবহমান জীবনধারার বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে নানা প্রপঞ্চ জড়িত। ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান যা ট্যানজিবল বা ইনট্যানজিবল হেরিটেজ হিসেবে আমাদের দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এতদিন গভীর উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হতো, সে সব উদ্‌যাপনের হার এখন কমে গেছে। কোনো কোনো উপাদান বিলুপ্তির পথে। এসব টিকে থাকার সঙ্গে এর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতা সম্পর্কিত। ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক সহজলভ্য উত্তেজক বিনোদন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হাতের নাগালে আসার কারণে লোকসংস্কৃতির এইসব উপাদান হারিয়ে যাচ্ছে। কোনটা কখন হারিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল। তবে বৈশাখের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের উৎসব, মেলা বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যে সংকুচিত হচ্ছে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখন যেখানে পরিবেশ আছে, তার ভোক্তা আছে বা দর্শক আছে সেখানে বাউল গান, বা মেলা, নৌকাবাইচ হচ্ছে। এগুলো চলতে থাকবে। তবে তার কিছু পরিবর্তন হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। গম্ভীরা এখনো পরিবেশিত হয় তবে তার বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়েছে। বর্ষার সময় ব্যাপকভাবে নৌকাবাইচ হয় এখনো। এদেশে এখনো গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশ ঐতিহ্যবাহী  সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সেটা চলতে থাকবে। বৈশাখের ব্যাপকতা লক্ষ্য করার মতো। এর সাথে জাতীয়তা, উৎসবকেন্দ্রিকতা, উদ্দীপনা, অর্থনৈতিক সংযোগ জড়িত।

বাংলা ট্রিবিউন: ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র পেছনে কোনো লোকঐতিহ্য আছে কি?

মোস্তফা তারিকুল আহসান: এটা ঠিক যে এখন যেভাবে বৈশাখ ঢাকা শহরে, অন্য বড় বড় শহরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পালিত হয়: র‌্যালি করে, মেলা বসিয়ে, আলোচনা চক্রের মাধ্যমে সেদিকে লক্ষ্য করলে আপাতভাবে মনে হবে এটা কেবল আমাদের জাতীয় উৎসব। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর সঙ্গে আধুনিক জীবনধারার অনেক কিছু যুক্ত হলেও বা এটা শহরকেন্দ্রিক হলেও এর মূল উৎস হলো আমাদের লোকসংস্কৃতি বা লোকমানস। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিয়ে মিলিত হবার প্রবণতা, আলপনা থেকে শুরু করে নানাবিধ আঁকাআঁকি, ফেস্টুন, চিত্রকর্ম সবার নেপথ্যে রয়েছে লোকসংস্কৃতির মৌল প্রবণতা, লোকসৃষ্টি, লোকনন্দনের সংযোগ। বাংলার প্রাচীন উৎসবের বৈশিষ্ট্যকে আধুনিকভাবে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে।



[ad_2]

Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত