শেখ হাসিনার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে অনুযায়ী এক নারীকে মাটিতে কোমড় পর্যন্ত পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে— এমন দাবিতে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছে।
ভিডিওতে শাড়ি পরিহিত এক নারীকে মাটিতে কোমড় পর্যন্ত পুঁতে রাখা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। তাঁকে ঘিরে রেখেছে একদল শিশু, তরুণ ও মধ্যবয়ী। একটু দূরে কিছুটা নিচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নারীদের একটি দল সেই দৃশ্য দেখছে। ভিডিওটির একপর্যায়ে নারীটির দিকে ঢিল ছুড়তে দেখা যায়। ঢিল নিক্ষেপকারীদের তিনজন মাথায় টুপি, সাদা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরিহিত। ভিডিওতে কান্নার আওয়াজও শোনা যায়।
এসব পোস্টের একটির ক্যাপশনে লেখা, ‘বাহ ইউনুস চমৎকার? এসব কি হচ্ছে বাংলাদেশে, বাঙালি জাতি হিসেবে আমি আজ লজ্জিত হতভম্ব। বাংলাদেশে কি শরীয়া আইন প্রয়োগ শুরু করেছে! শেখ হাসিনার অপরাধ ছিলো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা! শেখ হাসিনার অপরাধ ছিলো নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। শেখ হাসিনার অপরাধ ছিলো নারী কোটা নিশ্চিত করা। সেই নারীর বিশেষ এক অংশ শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্লোগান দিয়েছিল ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার বলে! তার পরিনতি আজ মধ্যযুগীয় কায়দায় নারীকে মাটিচাপা দিয়ে পাথর নিক্ষেপ। কারো কি ঘুম ভাংবে না! নাকি শুধু আওয়ামী লীগের সকল দ্বায়িত্ব! গত ৯ মাসে বিবেক আর অনুভূতির কাছে অসংখ্য প্রশ্নে বিস্মিত!!!’ (বানান অপরিবর্তিত)
Hindutva Knight নামে একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১৪ এপ্রিল রাত ১১টা ১৯ মিনিটে পোস্ট করা ২৮ সেকেন্ডের ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। ক্যাপশনে লেখা, ‘বাংলাদেশে একজন নারীকে পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনের ডিপ স্টেট এই নতুন বাংলাদেশকে ক্ষমতায় এনেছে।’ (ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত)
আজ মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) বেলা ১১টা পর্যন্ত ভিডিওটি ২ লাখ ৩২ হাজার বার দেখা হয়েছে, ৪১৩ টি কমেন্ট পড়েছে এবং রিপোস্ট (শেয়ার) হয়েছে ৪ হাজার।
‘True Tolk’, ‘Sadia Akter’, ‘নাটোর জয় বাংলা’ নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় একই ক্যাপশনে ১ মিনিট ১ সেকেন্ডের দীর্ঘ ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে।
এসব পোস্টে কেউ কেউ এই ভিডিওটি কোনো নাটিকার শুটিং উল্লেখ করে কমেন্ট করেছেন। আবার অনেকে সত্য মনে করেও মন্তব্য করেছেন। Barat Hossain নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘পাকিস্তানি কায়দায় এ-ই নির্যাতন শুরু করছে, বাংলাদেশর মানুষের উপর, জেগে উঠো বাংলাদেশ। ‘Matiur Rahman লিখেছে, ‘এই বর্বরতা কেন। প্রশাসন কোথায়? দেশে প্রচলিত আইন আছে।’
ভিডিওটির কিছু কি–ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলে bijoysarker015 নামে একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে পাওয়া যায়। ভিডিওটি ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ প্রকাশিত। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে থাকা নারী, তাঁর পোশাক, তাঁর অবস্থান, আশেপাশের মানুষ, তাঁদের পোশাকের সাদৃশ্য রয়েছে। ভিডিওতে লেখা আছে, ‘প্রবাসীর বউ, হায়রে পরকীয়া।’
এই ভিডিওর কমেন্টে অনেকেই এটি নাটকের শুটিং লিখে কমেন্ট করেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট শপথ নেন।
bijoysarker015 টিকটক অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি ২০২৩ সালের ১৬ মার্চে প্রকাশিত। অর্থাৎ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার অনেক আগে থেকেই এটি ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো যোগসূত্র নেই।
নারীকে পাথর মেরে শাস্তি দেওয়ার সত্যতা কতটুকু
বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য bijoysarker015 টিকটক অ্যাকাউন্টের ভিডিওটি খুঁটিয়ে দেখেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্তচেক বিভাগ। এতে বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখা যায়।
ভিডিওটির ৮ম সেকেন্ডে একজন যুবককে তার জড়ানো লাঠি সদৃশ বস্তু ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ভিডিওটির ১১ সেকেন্ডে আরেকজন যুবককে ক্যামেরা ধরে রাখতেও দেখা যায়। ভিডিওর বিভিন্ন সময় তার ছড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখা যায়। ৪৮ সেকেন্ডে পুরুষকণ্ঠে ‘অ্যাকশন’ বলতে শোনা যায়। ‘অ্যাকশন’ শব্দটি সাধারণত কোনো শুটিংয়ে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া তরুণীর দিকে নিক্ষেপ করা বস্তুগুলোর আকৃতি সমান এবং একই রকম। আর যে গতিতে বস্তুগুলো নিক্ষেপ করতে দেখা যায়, সে তুলনায় সেগুলো ধীর গতিতে মাটিতে গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। বরং বস্তুগুলো ফোম জাতীয় কিছু বলেই মনে হয়।
এ ছাড়া একই ভিডিও SHAMIM AHMED CIP নামে ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ ও Israt Jahan Sumi নামে ফেসবুক অ্যকাউন্ট থেকে ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে।
এসব অসঙ্গতি ও ভিডিওতে ক্যামেরার উপস্থিতি দেখে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, এই ভিডিওটির ঘটনাটি সাজানো। আর এটি বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর আগে থেকেই এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে।