শরীরের জন্য পানি অপরিহার্য। পানি কেবল তৃষ্ণা নিবারণ করে না, পাশাপাশি দেহের প্রতিটি কোষের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ত্বক সতেজ রাখে। সুস্থ থাকতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে দৈনিক পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা আবশ্যক।
তবে অনেকেই খাবার খাওয়ার সময় পানি পান করা থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা মনে করেন, খাওয়ার সময় পানি পান করলে হজমে সাহায্যকারী বা পাচক রসের ঘনত্ব কমে যায়। এতে খাবার হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং পুষ্টির শোষণ ব্যাহত হয়।
সত্যিই কি তাই? চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ।
যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি হাসপাতাল মায়ো ক্লিনিকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খাওয়ার সময় পানি পান করলে হজমে সমস্যা হয় ও হজমে সাহায্যকারী পাচক রস পাতলা হয়ে যায়, এই ধারণা সঠিক নয়। তবে হৃদরোগ, কিডনি বা লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পানি পানের পরিমাণ অনেকক্ষেত্রে সীমিত রাখতে হয়।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, পানি হজমের জন্য উপকারী। পানি খাবারকে ভাঙতে সাহায্য করে। এতে করে শরীর খাদ্য থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে। এ ছাড়া পানি লালা তৈরি করতে সাহায্য করে। পানি রক্ত ও প্রস্রাবের মতো শরীরের অন্যান্য তরলেরও অংশ। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে মল নরম হয়, যা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সহায়তা করে।
খাওয়ার সময় পানি পান করলে শরীরে তরলের দৈনিক চাহিদা পূরণ হয়। যদি কেউ শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে বা ওজন কমাতে চান, সেক্ষেত্রে খাওয়ার সময় পানি পান একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। কারণ, পানিতে কোনো ক্যালরি নেই। খাওয়ার সময় পানি পান করলে অতিরিক্ত ক্যালোরি ছাড়াই পাকস্থলি ভরা অনুভূত হয়। আর যদি কেউ ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করেন তাহলে স্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর মনোযোগ দিতে হবে ও খাওয়ার সময় পানি পান কমাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে পুষ্টিবিদ তামারা ডুকার ফ্রেওম্যানের লেখা ‘দ্য ব্লোটেড বেলি হুইস্পার’ বইয়ের সূত্রে বলা হয়, খাওয়ার সময় পানি পান করলে হজম বাঁধাগ্রস্ত হয়, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, হজম প্রক্রিয়া শুরু হয় মুখ থেকে। মুখে খাবার চিবিয়ে ভেঙে ফেলা হয় এবং লালার এনজাইম খাবার নরম করে। এরপর খাবার খাদ্যনালী দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছালে তা অম্লীয় তরলের মাধ্যমে রাসায়নিকভাবে ভেঙে যায়। এই মিশ্রণটি পরবর্তীতে ক্ষুদ্রান্ত্রে চলে যায়, সেখানে এটি পিত্ত রস এবং এনজাইমের সঙ্গে মিশ্রিত হয়। এই পর্যায়ে শরীরে প্রায় ৭৫ শতাংশ পুষ্টির শোষণ ঘটে। আর যেসব খাদ্য সেখানে শোষিত হয় না, সেগুলো বৃহদান্ত্রে প্রক্রিয়াজাত হয়। বাকি অংশ মল আকারে বেরিয়ে যায়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে।
আমেরিকান গ্যাস্ট্রো এন্টেরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গভর্নিং বোর্ড সদস্য ডেবোরা ডি. প্রক্টর ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘পানি পাকস্থলীতে পাচক রস পাতলা করে দেয় এই ধারণাটি কিছু কারণে সত্য নয়। প্রথমত, পানি পাকস্থলীতে সাধারণত প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে শোষিত হয়। এর মানে হচ্ছে পাকস্থলীতে যে কোনো সম্ভাব্য তরলীকরণ খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ফলে যদি পাকস্থলী পানি দিয়ে পূর্ণ থাকে, তবুও খাবার হজমে সমস্যা হবে না।’
একই বিষয়ে ভারত ভিত্তিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট অনলি মাই হেলথ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশটির শারদা হাসপাতালের সিনিয়র ডায়েটিশিয়ান ডা. শ্বেতা জয়সওয়াল বলেন, ‘স্বনামধন্য হাসপাতালের একাধিক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, খাওয়ার সময় পানি পান করলে পাকস্থলীর পিএইচের ভারসাম্য তেমন পরিবর্তন হয় না। খাওয়ার সময় পানি পান করলে তা হজমে সাহায্যকারী পাকস্থলীর অম্লীয় পরিবেশকে প্রভাবিত করে না।’