সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: হেমিংওয়ে ঠিক এই একই কৌশল ব্যবহার করতেন—সবসময় একটি বাক্য অর্ধেক লিখে রেখে দিতেন, যাতে পরের দিন সহজেই আবার যোগসূত্র ধরতে পারেন…
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: হ্যাঁ, তিনি ভাবতেন সবকিছু একসঙ্গে লিখে ফেলার পরিবর্তে, তাকে পরের দিন আরও সহজে শুরু করতে হবে। আমার জন্য সবসময় মনে হয়, সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে শুরু করা। সকালে আবার সংযোগ স্থাপন করা, তার উদ্বেগ…কিন্তু আপনি যদি অভ্যাসবশত কাজ করেন, ধরে নিন, ইতোমধ্যে আপনার ভেতরে মেশিন শুরু হয়ে গেছে। যাই হোক, আমার কাজের খুবই কঠোর রুটিন আছে। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাই, থাকি দুপুর পর্যন্ত। এই সময়টা আমার জন্য পবিত্র। এর মানে এই নয় যে, আমি সবসময় লিখি; মাঝে মাঝে পর্যালোচনা করি বা নোট নিই। কিন্তু আমি নিয়মিত কাজ করি। অবশ্যই, কিছু দিন থাকে সৃজনশীলতার জন্য ভালো, আর কিছু দিন খারাপ যায়। কিন্তু প্রতিদিন কাজ করি—এমনকি নতুন কোনো ধারণা যদি না-ও থাকে—তবুও আমি সেই সময়টাতে সংশোধন, পুনঃলিখন, নোট নেওয়া ইত্যাদি করি… কখনো কখনো শেষ করা লেখা পুনরায় লিখি, যদি শুধু যতিচিহ্ন বদলাতেও হয়।
সোমবার থেকে শনিবার আমি চলমান উপন্যাসের উপর কাজ করি। রবিবার সকালে সাংবাদিকতার কাজ করি—প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। চেষ্টা করি এই ধরনের কাজ রবিবারের নির্ধারিত সময়ে রাখার, যাতে সৃজনশীল কাজের উপর কোনো প্রভাব না পড়ে। কখনো কখনো আমি ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনি যখন নোট নেই, তবে গানের সাথে না। যখন আমি খুব আওয়াজ পূর্ণ বাড়িতে বাস করতাম তখন থেকে এটা আমি শুরু করি। সকালে একা কাজ করি। কেউ আমার অফিসে আসে না। আমি ফোন কলও নিই না। যদি তা করতাম, আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে যেত। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, কত ফোন ও দর্শক আসে। সবাই জানে এই বাড়ির ঠিকানা।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কখনো এই কঠোর রুটিন ত্যাগ করেননি?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: আমি জানি না। অন্যভাবে কাজ করতে পারি না। যদি অনুপ্রেরণার মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করতাম, তবে কখনোই বই শেষ করতে পারতাম না। আমার জন্য অনুপ্রেরণা হলো নিয়মিত পরিশ্রমের ফল। এই রুটিন আমাকে দিনের ওপর নির্ভর করে কাজ করার সুযোগ দেয়। এতে আনন্দ ও নিরানন্দ দুই-ই আছে।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: অন্যান্য লেখকদের মতো ভিক্টর হুগো অনুপ্রেরণার জাদুকরী শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন ‘One Hundred Years of Solitude’ নিয়ে বছরের পর বছর সংগ্রামের পর, গাড়িতে আকাপুলকো যাওয়ার পথে উপন্যাসটি তার মাথায় নিজেই লেখা শুরু করেছিল। আপনি সম্প্রতি বলেছেন, অনুপ্রেরণা আপনার জন্য শৃঙ্খলার একটি ফল—কখনো কি সেই ‘রোশনাই’ অনুভব করতে পেরেছেন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: এসব কখনোই আমার সাথে হয়নি। এগুলো অনেক ধীর প্রক্রিয়া। প্রথমে কিছুটা অস্পষ্ট থাকে, তারপর এক ধরনের সতর্কতা, এক ধরনের কৌতূহল কাজ করে। কুয়াশা এবং অস্পষ্টতার মধ্যে আমি এমন কিছু দেখতে পাই যা আমার আগ্রহ, কৌতূহল এবং উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে। তারপর এটি কাজ, নোট, গল্পের সারসংক্ষেপে রূপান্তরিত হয়। তারপর আউটলাইন পেয়ে কাজ শুরু করি। তখন কিছুটা অস্পষ্টতা, কিছুটা অস্পষ্টতা এখনও থাকে। ‘রোশনাই’ তখনই ঘটে যখন আমি কাজ করছি। কঠোর পরিশ্রমই—যেকোনো মুহূর্তে এই উপলব্ধি ও উত্তেজনা আনতে পারে—এই ‘রোশনাই’ প্রবর্তন করতে পারে। যখন কিছুদিন ধরে কাজ গল্পের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাই, হ্যাঁ, তখন কিছু ঘটে। গল্পটি আর আমার সাথে সম্পর্কহীন থাকে না। বরং এত জীবন্ত ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে আমি তা অনুভব করতে পারি। আমি যা কিছু শুনি, দেখি ও পড়ি তা আমার কাজকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করে। আমি বাস্তবতার এক ধরনের রাক্ষস হয়ে যাই। কিন্তু এই অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য কাজের ক্যাথারসিস পার করতে হয়। আমি এক ধরনের দ্বৈত জীবন যাপন করি। হাজারটা কাজ করি, কিন্তু সবসময় আমার মনে আমার লেখাই থাকে। অবশ্যই কখনো কখনো তা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। সেই সময়ে চলচ্চিত্র আমার বেশ উপকারে আসে। দিনের শেষে আমি যখন মানসিক অস্থিরতায় ভুগি, তখন চলচ্চিত্র আমাকে অনেক সাহায্য করে।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: পেদ্রো নাভা কিছু চরিত্রের ছবি আঁকতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন—তাদের মুখ, তাদের চুল, তাদের পোশাক। আপনি কখনো তা করেন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: না, তবে কিছু ক্ষেত্রে আমি জীবনীমূলক ফাইল তৈরি করি। তা নির্ভর করে আমি চরিত্রকে কীভাবে অনুভব করি তার ওপর। যদিও চরিত্রগুলো কখনো কখনো আমার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তবুও আমি তাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যমে বা তাদের চারপাশের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত হয়ে চিহ্নিত করি। তবে এমন হয়, যদি একটি চরিত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয় তবে তা আমাকে কাগজে লিখে রাখতে হয়। উপন্যাসের জন্য আপনি নোট নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো যা স্মৃতি নির্বাচন করে। যা রয়ে যায় তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কখনোই আমার গবেষণা অভিযানে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে যাইনি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: তাহলে কিছু সময়ের জন্য আপনার চরিত্রগুলি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত নয়? প্রতিটি তার নিজের ব্যক্তিগত ইতিহাস নিয়ে থাকে?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: শুরুতে সবকিছু এত শীতল, এত কৃত্রিম ও মৃত! প্রতিটি চরিত্র নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করে তখন আস্তে আস্তে সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে, যা অসাধারণ ও মুগ্ধকর: যখন আপনি আবিষ্কার করেন, গল্পে কিছু শক্তির রেখা স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান রয়েছে, তখন সেই মুহূর্তে পৌঁছানোর আগে কেবল কাজ, কাজ এবং আরও কাজ করে যেতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে কিছু মানুষ, কিছু ঘটনা, এমনকি কিছু পরিবেশ থাকে যেসবের শূন্যতা পূরণ করতে হয়। হঠাৎ আপনি বুঝতে পারেন, আপনার কাজের জন্য ঠিক যা জানা দরকার, তা আপনি জানেন। উপস্থাপন কখনোই বাস্তব ব্যক্তির সাথে সত্য নয়, তা পরিবর্তিত হয়, মিথ্যা হয়ে যায়। তবে এমন ঘটনার সাক্ষাৎ তখনই ঘটে যখন গল্পটি উন্নত স্তরে পৌঁছে যায়, যখন সবকিছু তাকে আরও পুষ্টি জোগায়। কখনো কখনো তা এক ধরনের স্বীকৃতিও: ‘ওহ, এটা আমি খুঁজছিলাম, সেই মুখ, সেই উচ্চারণ, সেই কথা বলার ধরন…’ অন্যদিকে, আপনি আপনার চরিত্রগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন, যা আমি প্রায়ই করি। কারণ আমার চরিত্রগুলি কখনোই শুধু যুক্তিযুক্ত চিন্তার মাধ্যমে জন্ম নেয় না। তারা আরও সহজাত শক্তি প্রকাশ করে। এজন্য কিছু চরিত্র তৎক্ষণাৎ আরও গুরুত্ব পেয়ে যায়। যেন তারা নিজে নিজেই বিকশিত হতে থাকে। তখন অন্যরা পেছনে চলে যায়। যদিও শুরুতে তাদের তা হওয়ার কথা ছিল না। এটিই কাজের সবচেয়ে মজাদার অংশ—যখন আপনি বুঝতে পারেন কিছু চরিত্র তাদের আরও গুরুত্ব পাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে, দেখতে পান গল্পটি নিজস্ব আইন অনুসরণ করছে, যেগুলি লঙ্ঘন করতে পারবেন না। এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, লেখক চরিত্রগুলিকে যেভাবে খুশি গড়তে পারে না, তাদের একটি নির্দিষ্ট আত্মনির্ভরতা রয়েছে। যখন আপনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে জীবন দেখতে পান তখনই এই আবিষ্কার করার সময়টা সবচেয়ে উত্তেজনাকর হয়। এই জীবনকে আপনার সম্মান করতে হবে।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনার বেশিরভাগ কাজ পেরুর বাইরে বসে লেখা, বলা যেতে পারে এক ধরনের স্বেচ্ছাস্বীকৃত নির্বাসন। আপনি একসময় বলেছিলেন, ভিক্টর হুগো নিজের দেশ থেকে বেরিয়ে আসার ফলে Les Misérables এর মতো উপন্যাস তৈরি হয়েছিল। বাস্তবতার ‘আবেগ’ থেকে দূরে থাকতে পারা কি সেই একই বাস্তবতাকে পুনর্গঠন করার জন্য এক ধরনের সুবিধা—তা কি আপনি কখনো অনুভব করেছেন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: হ্যাঁ, এই অর্থে যে আমি কখনোই নিজের খুব কাছের কিছু নিয়ে লিখতে পারিনি। নিকটতা একধরনের বাধা সৃষ্টি করে, কারণ তা আমাকে মুক্তভাবে কাজ করতে দেয় না। লেখালেখির জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বাধীনতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যাতে আপনি বাস্তবতাকে রূপান্তর করতে পারেন। চরিত্রদের বদলে ফেলতে পারেন। তাদের দিয়ে অন্যভাবে কাজ করাতে পারেন কিংবা আখ্যানের মধ্যে একেবারে ব্যক্তিগত ও ইচ্ছাধীন কোনো উপাদান যোগ করতে পারেন। তা-ই তো সৃজনশীলতা। বাস্তবতা যদি একেবারে আপনার চোখের সামনেই থাকে, তাহলে সেটা এক ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমি সবসময়ই কিছুটা দূরত্বে থাকতে চাই—সময়ের দিক থেকে, বা আরও ভালো হয় যদি সময় ও স্থান—উভয় দিক থেকেই।
এই জায়গা থেকে বললে, নির্বাসন আমার জন্য খুবই উপকারী হয়েছে। এর মাধ্যমে শৃঙ্খলা পেয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি, লেখালেখি আসলে একটা কাজ, এবং বেশিরভাগ সময়ই তা বাধ্যবাধকতা। দূরত্ব আমাকে আরও একটি বিষয়ে সাহায্য করেছে—আমি মনে করি, একজন লেখকের জন্য নস্টালজিয়া বা অতীতচারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে বলতে গেলে, বিষয়বস্তুর অনুপস্থিতি স্মৃতিকে আরও উর্বর করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, The Green House-এ উপস্থাপিত পেরু শুধু বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং একজন মানুষ যিনি সেই দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন তার গভীর আকাঙ্ক্ষা ও যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতির প্রতিফলন। একই সঙ্গে আমি মনে করি, দূরত্ব একটি কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। তা বাস্তবতাকে পরিশ্রুত করে—সেই জটিল বাস্তবতা, যা আমাদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। কী গুরুত্বপূর্ণ আর কী গৌণ তার নির্ধারণ করা খুব কঠিন হয়ে যায়। দূরত্ব সেই পার্থক্য তৈরি করতে সাহায্য করে। এটা মূল ও তুচ্ছ বিষয়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় স্তরবিন্যাস স্থাপন করে।
সাক্ষাৎকারকারী: আপনি কয়েক বছর আগে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, সাহিত্য একধরনের আবেগ, এবং সেই আবেগ একান্ত—যা সমস্ত ত্যাগ দাবি করে এবং নিজে কোনোরকম ত্যাগ করে না। “প্রাথমিক কর্তব্য বাঁচা নয়, লেখা” —ফার্নান্দো পেসোয়ার একটি উদ্ধৃতির মতো মনে হয়— “পথচলা প্রয়োজন, বাঁচা অপ্রয়োজনীয়।”
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: আপনি বলতে পারেন, লেখা প্রয়োজন এবং বাঁচা অপ্রয়োজনীয়…হয়ত আমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বললে ভালো হবে, যাতে মানুষ আমাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারে। ছোটবেলা থেকে সাহিত্য আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও স্কুল জীবনে অনেক পড়াশোনা এবং লেখালেখি করতাম, কখনো ভাবিনি শুধু সাহিত্যকে নিজ জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করব, কারণ সে সময় লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে পেরুর একজন মানুষের জন্য অনেকটা বিলাসিতা মনে হয়েছিল। আমি অন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম: আইন পড়তে, শিক্ষক হতে অথবা সাংবাদিকতা করতে। আমার জন্য যা প্রয়োজন তা পেছনে ফেলে দিতে হবে তা আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ইউরোপে স্কলারশিপ নিয়ে গেলাম, তখন বুঝতে পারি—আমি এভাবে ভাবতে থাকলে কখনো লেখক হতে পারব না এবং একমাত্র উপায় হবে সাহিত্যকে আমার প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করা। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সাহিত্যকে শক্তভাবে নিজের প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করব। যেহেতু এর মাধ্যমে আমি নিজের জীবন নির্বাহ করতে পারব না, আমি এমন কাজ খুঁজে নেব যাতে করে লেখালেখির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পাশাপাশি কখনোও অগ্রাধিকার হিসেবে থাকবে না। অন্যভাবে বললে, আমি এমন কাজেই বাছাই করব যাতে লেখক হিসেবে আমার কাজের সুবিধা দিবে। আমার মনে হয়, এই সিদ্ধান্ত আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল, কারণ তখন থেকেই পুরোদমে লেখার ক্ষমতা পেলাম। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়েছিল। এজন্যই সাহিত্য আমার কাছে পেশা নয়, আবেগ মনে হয়। অবশ্যই তা পেশা, কারণ আমি এতে জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু আমি যদি এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে না পারতাম, তবুও লিখে যেতাম। সাহিত্য আমার জন্য শুধু উপার্জনের মাধ্যম নয়। আমি মনে করি, অন্য কোনোকিছুর চিন্তা না করে একজন লেখকের জন্য সম্পূর্ণরূপে তার কাজের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু মানুষ একে অন্য কিছুতে নিবেদিত জীবনের এক ধরনের পরিপূরক বা অলংকারমূলক কার্যকলাপ হিসাবে মনে করেন, এমনকি মর্যাদা এবং ক্ষমতা অর্জনের উপায় হিসেবে দেখেন। সেই ক্ষেত্রে এক ধরনের বাধা তৈরি হয়—সাহিত্যই তার প্রতিশোধ নেয় অর্থাৎ আপনাকে স্বাধীনভাবে, সাহসিকতার সাথে এবং মৌলিকভাবে লেখালেখি করা থেকে আটকায়। এজন্য আমি মনে করি, পুরোপুরি আত্মনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুব অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভাবতাম হয়ত জীবনের কঠিন পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কেননা আমি কখনো ভাবিনি সাহিত্য আমাকে জীবিকা উপার্জনের উপায় করে দিবে, এমনকি ভালোভাবে জীবনযাপন করার মতোও। যেন এক ধরনের অলৌকিক ঘটনা। আমি এখনও অবাক হই। লেখার জন্য আমাকে কখনও মৌলিক কোনো বিষয় থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে হয়নি। আমি মনে করি, ইউরোপে যাওয়ার আগে এবং আমি যখন পেরুতে ছিলাম, তখন লিখতে পারতাম না জন্য খুবই হতাশ ও নিজের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলাম।
আমি খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলাম তাই আমাকে যেকোনো ধরনের কাজ করতে হতো। একসময় একসাথে ৭টি কাজ করতাম! স্বাভাবিকভাবেই, আমি লিখতে পারছিলাম না। রবিবার ছুটির দিনে লিখতাম, কিন্তু লেখালেখির সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিল না এমন বিরক্তিকর কাজগুলো করতে করতে অধিকাংশ সময় চলে যেতো। ফলে আমি এসব নিয়ে খুব হতাশায় ছিলাম। এখন আমি সকালে উঠে, ভেবে অবাক হই যে এমন জীবন কাটাতে পারি যা সবচেয়ে বড় আনন্দের এবং ভালোভাবে জীবিকা উপার্জনও করতে পারি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: সাহিত্য কি আপনাকে ধনী করেছে?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: না, আমি ধনী মানুষ নই। আপনি একজন লেখকের উপার্জনের সাথে যদি কোনো কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বা একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের উপার্জনের তুলনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন সাহিত্য এখনও কম পারিশ্রমিকের পেশা।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনি একবার বলেছিলেন, হেমিংওয়ে কোনো বই পড়া শেষ করে এক ধরনের শূন্যতা, দুঃখ এবং আনন্দ অনুভব করতেন। আপনার কেমন অনুভূতি হয়?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: একদম একই অনুভূতি। পড়া শেষে আমি শূন্যতা ও অস্বস্তি অনুভব করি। কারণ উপন্যাসটি আমার অংশ হয়ে ওঠে। একদিনের মধ্যেই নিজেকে তা থেকে বঞ্চিত হিসেবে দেখি—একজন মদ্যপের মদ ছেড়ে দেওয়ার মতন। তা কেবল আনুষঙ্গিক বিষয় নয়; হঠাৎ করে জীবনটা আমার কাছ থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়। একমাত্র উপশম হলো, হাতে অজস্র কঠিন কাজ থাকা সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি সহজ কোনো কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা। অবশ্যই কোনোরকম পরিবর্তন না করে কাজ শুরু করতে হবে, যাতে পূর্ববর্তী বইয়ের এবং পরবর্তী বইয়ের মধ্যে শূন্যতার গভীরতা না বাড়ে।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আমরা কিছু লেখকদের উল্লেখ করেছি যাদের কাজ আপনি প্রশংসা করেন। এখন আপনার নিজের কাজ নিয়ে কথা বলি। আপনি বেশ কয়েকবার বলেছেন ‘দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ আপনার সেরা বই। আপনি কি এখনও তাই মনে করেন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: এই উপন্যাসে আমি সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছি ও নিজেকে সবচেয়ে বেশি দিয়েছি। চার বছর সময় লেগেছে লিখতে। ব্যাপক গবেষণা, প্রচণ্ডরকমের পড়াশোনা এবং বড় বড় সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। কারণ প্রথমবারের মতো আমি নিজের দেশের বাইরে ভিন্ন একটি দেশের উপর লিখছিলাম। সময়টাও আমার নয়, এমনকি চরিত্ররাও এমন ভাষায় কথা বলত যা কিনা কোনো বইয়ে লিপিবদ্ধ ছিল না। কিন্তু কখনো এর মতো কোনো গল্প আমাকে এতটা উত্তেজিত করেনি। আমার পড়া জিনিস থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বদিকে ভ্রমণ পর্যন্ত কাজ সম্পর্কিত সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এজন্যই এই বইয়ের প্রতি এক ধরনের স্নেহ অনুভব করি। এই কারণেই সবসময় আমি সেই ধরনের উপন্যাস লিখতে পেরেছি যা আমি সবসময় লিখতে চেয়েছি—একটি অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস, যেখানে অ্যাডভেঞ্চার অপরিহার্য—সম্পূর্ণ কাল্পনিক অ্যাডভেঞ্চার নয় বরং ঐতিহাসিক এবং সামাজিক সমস্যাগুলির সাথে গভীরভাবে যুক্ত। সম্ভবত এ কারণেই আমি ‘দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’—কে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচনা করি। অবশ্য, এমন মূল্যায়ন সবসময় খুবই ব্যক্তিগত হয়। একজন লেখক তার কাজকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা রাখে না, যা কিনা এই ধরনের শ্রেণীবদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজন। উপন্যাসটি ভয়ংকর রকম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা আমি জয় করতে চেয়েছি। প্রথমে আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। বিশাল গবেষণা উপকরণের পরিমাণ দেখে বোধহয় আমার মাথা কাজ করছিল না। প্রথম খসড়া ছিল বিশাল, সম্ভবত উপন্যাসের আকারের দ্বিগুণ। আমি নিজেকে প্রশ্নের সম্মুখীন করি, কীভাবে সমস্ত চিত্রকল্প এবং হাজার হাজার গল্পের সমন্বয় করব। দুই বছর ধরে তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও সারতাও অঞ্চলে ভ্রমণের পর গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে। ইতোমধ্যেই একটি রূপরেখা তৈরি করি। আমি গবেষণা উপকরণের ভিত্তিতে প্রথমে গল্পটি কল্পনা করে তারপর ভ্রমণ করতে চেয়েছিলাম। ভ্রমণটি কিছু বিষয় নিশ্চিত করেছে এবং অন্য কিছুতে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। অনেক মানুষও সাহায্য করেছে। মূলত, বিষয়টি বইয়ের জন্য ছিল না। রুই গুয়েরার পরিচালনায় একটি চলচ্চিত্রের জন্য ছিল। সেই সময় প্যারামাউন্ট প্যারিসের একজন পরিচিত লোক আমাকে ফোন করে জানতে চাইল—আমি কি গুয়েরার জন্য একটি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখতে চাই কিনা।
আমি তার চলচ্চিত্র ‘টেন্ডার ওয়ারিয়র্স’ খুব পছন্দ করেছিলাম। তাই আমি প্যারিস গিয়ে তার সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে সবকিছু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে গল্পটি তিনি করতে চাচ্ছেন তা কানুডোস যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। আমরা কানুডোসের উপর চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারব না, কারণ বিষয়টি খুব বিস্তৃত ছিল কিন্তু কিছু এমন হতে হবে যা এর সাথে সম্পর্কিত। আমি কানুডোস যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কখনো শুনিনি। এসম্পর্কে গবেষণা করতে শুরু করি, পড়তে শুরু করলাম, এবং পোর্তুগিজ ভাষায় প্রথম ইউক্লিডেস দা কুনহার ‘ওস সারতাওস পড়ি’ যা ছিল আমার পাঠক জীবনের এক মহান আবিষ্কার। যেমন শিশুরা ‘থ্রি মুসকেটিয়ার্স’ পড়ে অথবা প্রাপ্তবয়স্করা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘মাদাম বোভারি’, এবং ‘মোবি-ডিক’ পড়ে। সত্যিই একটি শ্রেষ্ঠ বই, একটি মৌলিক অভিজ্ঞতা। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম; এটা লাতিন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। অনেক কারণে বইটি শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ বইটি “লাতিন আমেরিকানিজম”-এর একটি নির্দেশিকা—প্রথমবারের মতো আপনি আবিষ্কার করবেন লাতিন আমেরিকা কী নয়। আমদানি করা আদর্শের যোগফল নয়। ইউরোপ, আফ্রিকা, প্রাচীন আমেরিকা বা আদিবাসী সমাজ নয়—কিন্তু একই সময়ে এই উপাদানগুলির একটি মিশ্রণ, যা কখনও কখনও কঠিন এবং সহিংসভাবে একসাথে বাস করে। এই সমস্ত কিছু এমন একটি বিশ্ব তৈরি করেছে যা খুব কম কাজ সাহিত্যিক বুদ্ধিমত্তা এবং শৈলীতে ‘ওস সারতাওস’ এর মতো ধারণ করেছে। অর্থাৎ, যার জন্য আমি ‘দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটির অস্তিত্বের প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ—তিনি ইউক্লিডেস দা কুনহা। আমি মনে করি আমি সে সময়ে কানুডোস যুদ্ধ সম্পর্কে প্রকাশিত প্রায় সবকিছু পড়েছি। প্রথমে, একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছি, যেটা চলচ্চিত্র শিল্পের বিভিন্ন সমস্যা কারণ কখনো আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্পটি খুব উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, কাজও শুরু হয়েছিল, কিন্তু প্যারামাউন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চলচ্চিত্রটি তৈরি করবে না এবং তা হয়নি। রুই গুয়েরার জন্য তা হতাশাজনক বিষয় ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে যে বিষয়টি মুগ্ধ করেছিল—তাতে নির্ভর করে কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। তাই আমি আবার পড়তে শুরু করি, গবেষণা করতে শুরু করি, এবং আমি এমন এক উত্তেজনার সাক্ষী হয়েছি যা খুব কম বই আমাকে দিয়েছে। আমি প্রতিদিন দশ থেকে বারো ঘণ্টা কাজ করতাম। তবুও আমি ব্রাজিলের প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমি চিন্তিত ছিলাম তা হয়ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে…বিশেষত যেহেতু একজন ক্লাসিক ব্রাজিলিয়ান লেখক ইতোমধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিলেন। বইটিতে কিছু নেতিবাচক পর্যালোচনা ছিল, তবে মোটের উপর তা উদারতা এবং উৎসাহের সাথে গ্রহণ করা হয়েছিল—পাঠকদের কাছ থেকেও তা আমাকে স্পর্শ করেছিল। আমি আমার প্রচেষ্টার জন্য পুরস্কৃত বোধ করেছি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনি কী মনে করেন, কানুডোসের যে ভুল বোঝাবুঝির পরিণতি ছিল, তা একটি রূপক হতে পারে মতবাদ বা মতাদর্শের জন্য? যেমন, প্রজাতন্ত্রের পক্ষের লোকেরা বিদ্রোহীদের মধ্যে রাজতন্ত্র এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিপর্যয় দেখতে পেয়েছিল আবার বিদ্রোহীরা নিজেদের মনে করেছিল তারা শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করছে?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: হয়ত একজন লাতিন আমেরিকার জন্য এখানেই কানুডোসের মূল্য লুকিয়ে আছে। কারণ বাস্তবতার প্রতি ফ্যানাটিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা উৎপন্ন পারস্পরিক অন্ধত্বও সেই অন্ধত্ব যা আমাদের বাস্তবতা এবং তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বৈপরীত্য দেখতে বাধা দেয়। লাতিন আমেরিকার ট্র্যাজেডি হলো, ইতিহাসের নানা মুহূর্তে আমাদের দেশগুলি বিভক্ত হয়ে গেছে এবং নাগরিক যুদ্ধ, ব্যাপক দমন-পীড়ন, কানুডোসের মতো গণহত্যার শিকার হয়েছে—এই একই পারস্পরিক অন্ধত্বের কারণে। হয়ত এ কারণে আমার কানুডোসের মুগ্ধতা তৈরি হয়। কারণ সেটা যেন ছোট আকারে গবেষণাগারে দেখা গেছে। তবে স্পষ্টতই তা একটি সাধারণ ঘটনা: ফ্যানাটিসিজম এবং অসহিষ্ণুতা আমাদের ইতিহাসে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তা সে মেসিয়ানিক বিদ্রোহই হোক, সোশ্যালিস্ট বা ইউটোপিয়ান বিদ্রোহ হোক, অথবা রক্ষণশীল এবং উদারপন্থিদের মধ্যে লড়াই হোক। যদি ইংরেজরা এর পেছনে না থাকে, তবে ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদীরা বা ফ্রিম্যাসনরা অথবা শয়তান আছে। আমাদের ইতিহাস আমাদের মতপার্থক্যের প্রতি অগ্রহণযোগ্যতার দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে।