[ad_1]
সাহিত্য বিভাগের আয়োজনে নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি অহ নওরোজ। তার জন্ম বাংলাদেশের যশোর জেলার অভয়নগরে। ঢাকায় অনেক দিন চাকরিসূত্রে সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে বার্লিনে অধ্যয়নের পাশাপাশি শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন। প্রকাশিত বই: রোমন্থনের সনদ [কবিতা, কবি প্রকাশনী], অতিলৌকিক কবিতাসমূহ [বাংলা-জার্মান দ্বিভাষিক কবিতা, অনুবাদ প্রকাশন], মহাকাশের রহস্য [জ্যোতির্বিজ্ঞান, অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি], কম্বুরেখপদাবলি [অনুপ্রাণন প্রকাশন]।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?
অহ নওরোজ: বিশেষত বাংলা শব্দের সৌন্দর্য ও শব্দের ভেতরকার ইমেজ আমাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে। শব্দের ভেতরকার গীতিময়তা আর নির্মাণের আনন্দই আমাকে কবিতা লেখায়। এছাড়া চৈতন্যের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া যে-সব বোধ আমাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে, তাদের মধ্যে প্রকৃতি বিষয়ক ভাবনা, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও উপলব্ধির কথা বলতেই হয়। যাপিত জীবনের দৈনন্দিন, একঘেয়ে, স্থূল চিন্তা ও স্মৃতির ভেতর যে-সব বেঁকে যাওয়া সূক্ষ্ম ভাবনা, বোধের স্কন্ধে হাত রাখে, যাকে আপাতভাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, ভেবে ভেবে পর্যাপ্ত তৃপ্তি আসে না, সেই সব সূক্ষ্মতাকে শব্দের শরীরে দেখার ইচ্ছেরা—কবিতা লেখার জন্য আমাকে উসকে দেয়। আমার ভেতর ঢুকে পড়া সৌন্দর্য গড়ার আকাঙ্ক্ষা—আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
অহ নওরোজ: যা কিছুই আমার করোটিতে দার্শনিক ভাবনা আনে, যা কিছুই সৌন্দর্য রাখে মাথার চারপাশে, যা কিছুই বুকের ভেতরে গজিয়ে তোলে নিসর্গভাবনা, সে সবই কবিতায় লিখতে আমার আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?
অহ নওরোজ: দুই-ই। অনেক সময় লিখতে ইচ্ছে হয়, লিখতে বসি, কোনো একটা অদ্ভুত নিয়মে লেখার প্রবাহ আসে আর লেখা হয়ে যায়। পরে সম্পাদনা করি। আবার অনেক সময় কোনো ভাবনা লিখতে উৎসাহিত করলেও পরিস্থিতি না থাকায় লেখা হয় না। তখন টুকে রাখি। পরে সেই ভাবনা থেকে মুক্তি না পেলে বাধ্য হয়ে লিখতে বসি।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?
অহ নওরোজ: আমার কবিতার ভাষার ক্ষেত্রে, সেভাবে পরিকল্পিতভাবে কখনো কিছু করিনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি, পড়ার সময় যদি কোনো শব্দ ভালো লাগে, তারা মাথার ভিতরে অজানিত ছকে ঢুকে যায়। সম্ভবত শব্দগুলোর গীতিময়তা আমাকে প্রলুব্ধ করে, আর নির্দিষ্ট কিছু অর্থ প্রকাশের বেলায় নিজেই লেখার ভেতরে এসে পড়ে। ধারণা করি, এই শব্দগুলোর নিয়মিত ব্যবহার আমার কবিতার ভাষা নির্মাণে ভূমিকা রাখে। তবে অনেক সময়, দুটি শব্দ ক্রমান্বয়ে বসিয়ে একটি তৃতীয় অর্থ তৈরি করার চেষ্টা আমার থাকে। এটা আমার কাছে এক ধরনের জ্ঞানীয়-খেলার মতো। সম্ভবত, এই চর্চাও আমার কবিতার ভাষার নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর যেহেতু সৌন্দর্য-নির্মাণ আমার কবিতা লেখার প্রধানতম প্রচেষ্টার একটি, সে কারণে ভাষা আর সৌন্দর্যকে কাছাকাছি রাখার প্রয়াস তো থাকেই। ভাষায় সৌন্দর্য বলতে আমি কী বুঝি, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
শৈলীর ক্ষেত্রে আমাকে কিছুটা এক্সপেরিমেন্টাল বলতে পারেন। অবশ্য ভাষার গতিশীলতা কীভাবে বজায় রাখা যায়, সে প্রচেষ্টা আমার সবসময়ই থাকে। প্রথম দিকে কারো কোনো স্টাইল ভালো লাগলে, সেটা নিজের মতো করে কবিতায় উত্তীর্ণ করার চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো কোনো কবির কবিতার ভেতরকার গীতিময়তা বোঝার চেষ্টা করতে করতে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। যদিও অধিকাংশ সময়ে এভাবে লেখা কবিতা আমাকে আশাহত করেছে, লিখতে পারার আনন্দ ঠিক দিতে পারেনি বলে, ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলোই আমার কবিতার শৈলী-সচেতনা গড়ে তুলতে প্রভাবিত করেছে। এখানে ছন্দের কথা না বললেই নয়। আমি মনে করি, কোনো লেখা যে-সব কারণে কবিতা হয়ে ওঠে, তাদের মধ্যে ছন্দ প্রধানতম। একটি লেখা তখনই কবিতা হয়ে ওঠে যখন গীতিময়তা তৈরি করে এমন কোনো নিয়মে তার শরীর গড়া। না হলে সে আর যা-ই হোক, কবিতা হয় বলে মনে হয় না। এই নিয়মকেই তো ছন্দ বলি। প্রচলিত ছন্দ হতেই হবে, সে কথা আমি বলছি না। আমার ধারণা, ছন্দের চর্চা ও প্রয়োগ আমার কবিতার শৈলীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
তবে সবকিছুর পরও, শৈলীর ক্ষেত্রে (বিশেষ করে দ্বিতীয় গ্রন্থের পর) নিজের মতো করে পরিকল্পনামাফিক কিছু চেষ্টা থাকে। যেমন, ‘সান্ধ্যসনেট’ সিরিজের কবিতায় চেষ্টা করেছি নিসর্গবিষয়ক শব্দের মোড়কে, অসমাপিকা ক্রিয়ায় গেঁথে বিষয়ের প্রবর্তনা ও পরিণতি উপস্থাপন করতে, বা ভ্রমণকবিতার সিরিজে বয়ানকে কবিতার শরীরে নির্মাণ করতে। তবে এসব চেষ্টা তখনই করি, যখন দেখি নিজের ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছি। যেহেতু আনন্দ ছাড়া কবিতার কাছ থেকে আমার আর কিছু পাওয়ার নেই, সে কারণে জোর করে নির্মাণের প্রচেষ্টা আনন্দই কেবল ব্যহত করে না, সময়কেও অর্থহীন করে তোলে।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?
অহ নওরোজ: যাদের লেখা পড়ে আনন্দলাভ হয়েছে তাদের প্রভাব তো চেতনে-অবচেতনে আছেই। দাশ থেকে মাহমুদ, ঘোষ, রিলকে থেকে পেসোয়া, সার্ভান্তেস থেকে মিল্টন, বাসো থেকে পুশকিন, হুইটম্যান থেকে পাররা, আরও অনেকেই আমাকে প্রভাবিত করেছেন। আমি আনন্দ নিয়ে প্রভাবিত হয়েছি। এত বড় বড় কবিদের থেকে প্রভাবিত হতে পারাও সৌভাগ্যের বলে মানি।
বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?
অহ নওরোজ: কবিতার থেকে তুলনামূলক কম, তবে করি। কথাসাহিত্য শুধু নয়, ভ্রমণ, অনুবাদ ও প্রবন্ধ সাহিত্যের চর্চাও করি। কিন্তু কবিতার মতো উল্লেখযোগ্য হারে করা হয় না। শিল্পের যেকোনো শাখারই চর্চা অন্য শাখাকেও প্রভাবিত করে। চিন্তা করার অভ্যাস থেকে শুরু করে কবিতায় শব্দ প্রয়োগের অনায়াস, সবকিছুই কথাসাহিত্যের চর্চাকে প্রভাবিত করে। ভাষা নির্মাণের চর্চা কথাসাহিত্যের ভেতর দারুণ পাওয়া যায়। তবে আমার মনে হয়েছে, কথাসাহিত্যের চর্চা কবিতাকে বিশদ বয়ানের দিকে ঠেলে দেয়, অনেক সময়ই কবিতার শরীর নির্মাণের সময় কবিকে অনিচ্ছুক কোলাহলের ভেতর কাঁপায়।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?
অহ নওরোজ: প্রথম কবিতার বই আসলে বই হিসেবে লেখা হয়নি। বা, বই হিসেবে প্রকাশিত হবে সে-রকম কোনো ভাবনা থেকেও বইয়ের কবিতাগুলো লেখা হয়নি। কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল শব্দ আবিষ্কার করতে করতে। পরে কিছু কবিতা একত্র করে বই হিসেবে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশের পেছনে আমার কাছের বন্ধু-বড়ভাই-শুভাকাঙ্ক্ষীরা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিলেন। আমি কখনোই ভাবিনি বই প্রকাশ হবে। ভালো লাগতো বলে লিখতাম। ফলে, ঠিক বই বলতে আমি এখন যা বুঝি, সেটা আমার প্রথম এবং দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। কবিতাগুলো লেখার সময়, বা লেখা হলে মনে হতো বিশেষ কিছু লিখে ফেলেছি, বিখ্যাত হয়েই যাবো। এখন মনে হয় কবিতার কিছুই হয়নি। হওয়া তো দূর কি বাত, কোনো গঠনমূলক প্রচেষ্টাও বই দুটিতে নেই। কবিতাগুলোতে নেই কোনো সচেতন ফর্ম বা ভাষার প্রচেষ্টা, কেবল কিছু লেখা আর তার ভেতরে অর্থ তৈরির ইচ্ছা। বলা যায়, হাতে খড়ির আগে খড়ি ধরার চর্চা। এখন তাকে (দ্বিতীয় বইটিকেও) কেবলই খসড়া বলে বিবেচনা করি।
বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?
অহ নওরোজ: না, সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা আমার কবিতায় প্রভাব ফেলে না। কবিতার মননকে প্রভাবিত করলেও তা অতি সামান্য।
বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?
অহ নওরোজ: আমার পাঠক আদৌ আছে কিনা সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। তবে যে কবি-বন্ধুদের পড়ার জন্য ঘটা করা কবিতা পাঠাই—তাদের মতামতকে বিবেচনা করি।
বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?
অহ নওরোজ: ভবিষ্যতে কী করবো এটা নিয়ে ঘটা করে কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে সম্প্রতি মন্দাক্রান্তা ছন্দে কিছু রুবাইয়াত লিখেছিলাম, হয়ত ইচ্ছে হলে আরও কিছু লেখা হবে। অনেকদিন ধরে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখছি, সেটা শেষ করার তাড়না ভেতর থেকে পাচ্ছি, সেটা শেষ করার চেষ্টা থাকবে। আর ভ্রমণের ভেতর পর্যটনের সুখলাভে সম্প্রতি কিছু কবিতা লেখা হয়েছে, সম্ভবত এই সিরিজটি চলতে থাকবে। এর থেকে বেশি আপাতত আমার জানা নেই।
[ad_2]
Source link