Homeসাহিত্যসময়ের রূপক ‘ক্রীতদাসের হাসি’

সময়ের রূপক ‘ক্রীতদাসের হাসি’


কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান একবার বন্ধুদের সাথে ছুটি কাটাতে বেরিয়ে পড়লেন, যেদিকে দু-চোখ যায়। রূপকথার রাজ্যের মতো যেতে যেতে যেতে—এক গহিন গাঁয়ে এসে থামলেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বান্ধবী রউফন নেসার বাড়ি এই গাঁয়ে। একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রধান শিক্ষয়িত্রী হিসেবে একরকম নিভৃত জীবন-যাপন করছেন তিনি। বান্ধবীর আতিথেয়তায় মহাসমারোহে দিনটি উপভোগ করেন তারা। সেখানেই এক বিশেষ রত্নভান্ডারের সন্ধান পেলেন শওকত ওসমান। রউফনের পিতামহ শাহ ফরিদউদ্দীন জৌনপুরী, নব্বই বছর বয়সী আরবি ফারসি ভাষায় পণ্ডিত এক মৌলানা। তার আছে প্রত্নতত্ত্বের বিশাল সংগ্রহশালা। হালাকু খান যখন বাগদাদ ধ্বংস করে, অসংখ্য মূল্যবান বইসহ লাইব্রেরিও ধ্বংস হয়ে যায়। কিছু পাণ্ডুলিপি সেসময় পলায়নপর মানুষের সাথে চলে আসে হিন্দুস্থানে। সেসব পান্ডুলিপির মধ্যে একটি হলো আলিফ লায়লা ওয়া লায়লানে, নানা হাত ঘুরে মোগল সুবেদার শাহ সুজার পাঠাগারে সেটি স্থান পায়। আরাকানে পালিয়ে যাবার সময় মুর্শিদাবাদের এক ওমরাহের কাছে সেটি রেখে যান তিনি। অবশেষে পান্ডুলিপিটি জৌনপুরে রউফুনের পিতামহের হাতে আসে।

শওকত ওসমান এবং বন্ধুরা মিলে তো হৈচৈ করতে লাগলেন যে আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা, বইয়ের নাম তো এক হাজার এক রাত, লায়লানে হলে এক হাজার দুই রাত হয়ে যায়। তিনি জানালেন এটিই মূল বই, তোমরা যেটি পড় সেটি আসল নয়।

শওকত ওসমান পাণ্ডুলিপি খুলে হতবাক, শেষ গল্পটির নাম জাহাকুল আবদ বা ক্রীতদাসের হাসি। তিনি রউফুনের পিতামহকে অনুরোধ জানালেন তাকে অনুবাদের অনুমতি দেবার জন্য। এতো বিস্ময়কর একটি সংবাদ, জাতিকে জানানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি।

পিতামহ রাজি হবার সাথে সাথে শওকত ওসমান ছুটি বাতিল করে বন্ধুদের নিয়ে ঢাকায় ফিরলেন বই প্রকাশের জন্য। ১৯৬৩ সালে ওয়ার্সি বুক সেন্টার থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ক্রীতদাসের হাসি’। সে বছরেই বইটি আদমজী শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করে।

‘ক্রীতদাসের হাসি’-এর পটভূমিতে চোখ বুলাতেই আমার সামনে কল্পলোকের দ্বার খুলে গেল যেন। আরব্য রজনীর জাদুর কার্পেটে চড়ে পলকেই কত শত বর্ষ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মুসলিম রেনেসাঁর সেই স্বর্ণযুগে। খলিফা হারুনুর রশিদের সহচর হয়ে বেরিয়ে পড়ি রাতের বাগদাদ শহরে। দজলার তীর থেকে দুরন্ত ঢেউ ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাসে দুলতে থাকে খেজুর শাখা আর আঙুরলতা।

তারাভরা আকাশের নীচে জমজমাট সরাইখানাগুলো থেকে কানে আসে নূপুরের রুমঝুম। বাতাবি ফুলের ঘ্রাণে ভরা রাজপ্রাসাদের কাওসার বাগ। কিন্তু এত প্রাচুর্য আর শানশওকতের ভেতর থেকেও খলিফা তার মানসিক অস্থিরতাকে কাটাতে পারছেন না, হাসতে পারছেন না প্রাণ খুলে। মাত্র কয়েকদিন আগে প্রিয় সুহৃদ এবং পরামর্শদাতা জাফরকে তিনি কতল করেছেন, নিজের বোনকেও বাঁচতে দেননি। কেননা তিনি মেনে নিতে পারেননি যে তার বোন বার্মেকি বংশের জাফরকে ভালোবাসুক আর আব্বাসীয় রক্ত বার্মেকি রক্তে মিশে যাক। সেজন্য কোনোখানে গিয়েই শান্তি পাচ্ছেন না খলিফা।

এরই মাঝে হঠাৎ তিনি ভুবন ভোলানো হাসি শুনতে পান এবং জেনে অবাক হন যে তার ক্রীতদাস হাবশি গোলাম তাতারি এভাবে হাসছে। বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হয় যে, গোলাম হাসছে অথচ তিনি কতদিন হাসেন না। পরে অনুসন্ধানে জানা যায় তাতারি এবং তার প্রেমিকা স্ত্রী মেহেরজানের প্রেমাকুল সান্নিধ্যে থাকবার সময় এমন হাসি শোনা গিয়েছিল।

হারুনর রশীদ প্রেমিকযুগলকে বিচ্ছিন্ন করে দেন, মেহেরজানকে নিজের হারেমে রাখেন। তাতারিকে নিয়মিত হাসি শোনানোর শর্তে প্রচুর ধনসম্পদের মালিক করে দেন।

মুক্তচিন্তক এবং প্রগতিশীল লেখক শওকত ওসমান এই উপন্যাসটি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসন আমলকে রূপক অর্থে তুলে ধরেছেন। উন্নয়নের ছুতোয় পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করা হয়েছিল সে সময়, জনগণের ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই অবরুদ্ধ জনগণের রূপকচরিত্র এই উপন্যাসের ক্রীতদাস তাতারি। শওকত ওসমান যেমন শাসকের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, তেমনি এই বইটিতেও আমরা শুনি খলিফার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা একমাত্র কণ্ঠস্বর একজন কবি আবু নওয়াসের। চরিত্রটি আমার খুব ভাল লেগেছে। বিশেষত তার সংলাপ, ‘আমি কবি, চিরন্তনের কণ্ঠস্বর ‘কিংবা’ কবিমাত্রই রক্তবীজ, বিবেকের নিষ্কাম সাধক।’

শওকত ওসমান খলিফার সময়কালকে জীবন্ত করে তুলেছেন আরবি বা ফারসি শব্দযোগে সংলাপ রচনায়। ‘আসসামায়ো তায়তান—শ্রবণ অর্থ পালন বা শিরোধার্য জাঁহাপনা।’ খানিক পরপরই উজির, নাজির, প্রহরী বা দাসদাসী শির ঝুঁকিয়ে বলছে, কিংবা জিল্লুল্লাহ বা আমিরুল মুমেনীন সম্বোধন করা যেন পাঠকহৃদয়ে রাজদরবারের আবহ তৈরি করে।

উপন্যাসের দৃশ্যপটগুলো কখনো কখনো মঞ্চনাটক উপভোগের স্বাদ এনে দেয়। যুবাইদার স্নেহ প্রবণ মন যেমন ছুঁয়ে যায় মেহেরজান আর তাতারির প্রতি মমতা আর ভালোবাসার প্রকাশ দেখে; তেমনি নিজের না পাওয়াকে নিজেদের প্রেমের মাঝে খুঁজে ফিরছেন এটিও পাঠক-মনকে বেদনাকাতর করে।

বইয়ের শেষাংশে মহাপরাক্রমশালী খলিফা হেরে যান তাতারির কাছে। ধনসম্পদ, নারীসঙ্গ, নির্যাতন এমনকি প্রাণের বিনিময়েও তাতারির কাছ থেকে তিনি হাসি কিনতে পারেননি। আত্মাকে বন্দী করে রেখে হাসি পাওয়া যায় না, কেননা “হাসি আত্মারই প্রতিধ্বনি”।

দাসপ্রথা, খেলাফত শাসন কিছুই নেই আজ। আইয়ুবশাহীরও পতন হয়েছে সেই কবে! কিন্তু ক্রীতদাসের হাসির প্রতিটি চরিত্র স্থান, সময়কাল অতিক্রম করে আমাদের মাঝেই মিশে আছে, তাইতো এটি চিরায়ত গ্রন্থমালায় স্থান করে নিতে পেরেছে।
তবে হ্যা, আরব্য রজনীর গল্প মোট এক হাজার একটি জানা সত্ত্বেও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম যে আসলে এক হাজার দুটি গল্প, শেষ গল্পটি পৃথিবীতে কেউ জানতে পারেনি। ভাগ্যিস শওকত ওসমানের বান্ধবী রওফুন নেসা ছিলেন, তার আরবি-ফারসিতে পণ্ডিত মৌলানা দাদু ছিলেন, যিনি জৌনপুরে গিয়েছিলেন, পান্ডুলিপিটি সংরক্ষণ করেছিলেন, ছুটি পেয়ে লেখক নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়েছিলেন এবং যেতে যেতে যেতে…

প্পাঠকের কাছে প্রশ্ন, আপনি কি মুহূর্তের জন্যও সংশয়ে পড়েছিলেন?

এখানেই আমাদে কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমানের লেখার জাদু! এমন আকর্ষণীয়ভাবে পটভূমি তৈরি করেছেন যে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি আমরা।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত