Homeসাহিত্যসময়, সমাজ ও ব্যক্তি সম্পর্কের আখ্যান

সময়, সমাজ ও ব্যক্তি সম্পর্কের আখ্যান


গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’ একটি অনবদ্য সাহিত্যকর্ম, যা শুধু লাতিন আমেরিকার নয়, বরং পুরো বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। এই উপন্যাসের গভীরতা, বিষয়বস্তু এবং রচনাশৈলী আজও পাঠক-মনকে আকর্ষণ করে। ইতিহাস, সমাজ, এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের এক গভীর আখ্যান এই উপন্যাস, যা পাঠককে শুধু একটি কল্পনার দুনিয়ায় নিয়ে যায় না, বরং বাস্তবতা ও কল্পনা সিমেট্রিকভাবে মিশিয়ে দেয়—মিশিয়ে দেয় অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যাকে জাদুবাস্তবতা বলা হয়।

ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা একটি সাহিত্যিক শৈলী, যেখানে বাস্তবতা ও অলৌকিকতার মিশ্রণ ঘটে। এই শৈলীতে, লেখক বাস্তব পৃথিবীর ঘটনাবলিকে কল্পনা ও অলৌকিক উপাদানগুলোর সাথে এমনভাবে একত্রিত করেন, যাতে পাঠক কখনোই বুঝতে পারেন না কোনটি বাস্তব এবং কোনটি কল্পনা। সাধারণ ও বাস্তবিক ঘটনা পাশাপাশি অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে, এবং এই ঘটনাগুলি বাস্তবতার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ম্যাজিক রিয়ালিজমের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মানব জীবনের জটিলতা এবং আবেগগুলোকে প্রকাশ করার জন্য বাস্তবতা এবং অলৌকিকতা একত্রিত করে। অলৌকিক ঘটনাগুলি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য ও স্বাভাবিক মনে হয় এবং তাদের পেছনে কোনো বিস্ময় বা অস্বাভাবিকতা থাকে না।

আজও ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু-বাস্তবতার লেখক চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতা সৃষ্টি করেন। সমাজের মানুষের চোখে অনেক ভৌতিক অভিজ্ঞতা কিংবা অলৌকিক ঘটনা থাকে। সত্য বলে বিশ্বাস ও চর্চিত হয় নানা অসংজ্ঞায়িত বিষয়াদি। জাদুবাস্তবতার লেখক সেই বাস্তবটাকে তুলে ধরেন। অর্থাৎ জাদুবাস্তবতা অন্যান্য উপাখ্যান কিংবা সায়েন্স ফিকশনের মতো ধারণা বা সম্ভাব্যতা নির্ভর নয়। ভিন্ন চোখে পৃথিবী দেখার প্রচেষ্টা বা অভিজ্ঞতা। যেখানে লৌকিক আর অলৌকিকের মধ্যে ফারাক নেই। গোড়াতে লাতিন আমেরিকায় এই ধারার ঝোঁক থাকলেও তা আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে যায় দ্রুতই।

মার্কেসের এ উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে যেভাবে নতুন দিক উন্মোচন করে দিয়েছে, সাহিত্যিকদের যেভাবে ভাবিয়েছে; তার তুলনা বিরল। নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এ উইলিয়াম কেনেডি খুব সম্ভবত সবচেয়ে সঠিক কথাটাই বলেছেন, “বুক অব জেনেসিস এর পরে প্রথম সাহিত্যিক মাস্টারপিস, যা সমগ্র মানবজাতির পাঠ করা উচিত।”

এ উপন্যাসের গল্পের ব্যাপ্তি মহাকাব্যিক—জনৈক প্রুডেনসিও আগু্‌ইলারের সাথে মোরগ যুদ্ধে নামলেও শেষ পর্যন্ত বিবাদটা ব্যক্তিগত দিকে গড়ায়। রাগের মাথায় তাকে হত্যা করেন হোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া। কিন্তু মৃত্যুর পরেও পিছু ছাড়ে না প্রুডেনসিও। শেষ পর্যন্ত ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবার নিয়ে থিতু হন নদীর পাশে জনহীন এক গ্রাম মাকোন্দোতে। মাকোন্দো যেন আলাদা এক পৃথিবী—এক ভিন্ন জগৎ—পরিচিত পৃথিবীর সাথে যোগাযোগহীন জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে বুয়েন্দিয়া বংশের প্রতিষ্ঠা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এবং স্ত্রী উরসিলা ইগুয়ারান দিয়েই শুরু, তারপর পরবর্তী ছয় প্রজন্ম ধরে বসবাস মাকোন্দোতে। নাম আর চারিত্রিক সাদৃশ্য অনেকটা দ্বিধায় ফেলে দেবার মতো হলেও পেছনে আছে এক গভীর তাৎপর্য এবং এ উপন্যাসের পরতে পরতে রয়েছে রহস্য।

প্রজন্মের ব্যবধানে মানুষের ভেতরে বাস্তবিক অর্থে বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। সারা পৃথিবীই যেন ঘুরে চক্রাকারে—ঘুরেফিরে মানুষের আদিম স্বভাবগুলোর পুনরাবৃত্তি হয়। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন নদীর পাশে এক গ্রাম—মাকোন্দো; জিপসিরা মাঝে মাঝেই আসে মাকোন্দাতে। সাথে নিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রযুক্তি—যার কিছু কিছু তাদের কাছে জাদুর মতো লাগে। মেধাবী, কৌতূহলী এবং বুদ্ধিমান হোসে আর্কাদিও তা সাগ্রহে গ্রহণ করে, সেই সাথে চর্চা করে আলকেমি। তৈরি করে সোনার মাছ। তার বৈশিষ্ট্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়েছে—বংশের পতন পর্যন্ত। রহস্যময় জিপসি মেলকিয়াদেস হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার হাতে একটা পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়। বস্তুত তা ছিল বুয়েন্দিয়া বংশের আদ্যোপান্ত বিবরণ। আমৃত্যু চেষ্টা করেও তার পাঠোদ্ধার করতে পারেননি তিনি। দুই পুত্রের মধ্যে হোসে আর্কাদিও লাভ করে তার শারীরিক সক্ষমতা আর উদ্দামতা এবং অরেলিয়ানো পায় আধ্যাত্মিক মনোযোগ। ঘটনা বিবৃত হয়েছে এভাবেই। সময় নিয়ে অভিনব এক খেলা খেলেছেন মার্কেস। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে ঘটবে বলে কিছু কথা এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যেন অতীতের প্রত্যক্ষ ঘটনার মতোই সেগুলো নিশ্চিত।

বহু বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়বে সেই বিকেলের কথা; যেদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে বরফ আবিষ্কার করেছিল তার বাবা’—উপন্যাসের প্রথম লাইনটার মতো এমন অভিব্যক্তি তাই খুব সাধারণ। রক্ষণশীল এবং উদারপন্থিদের মধ্যকার সংঘর্ষ, গৃহযুদ্ধ, নিদ্রাহীনতার মহামারি কিংবা দীর্ঘদিনব্যাপী বৃষ্টিপাত ধাপে ধাপে উঠে বুননের মতো। অরেলিয়ানো উদারপন্থি দলে গিয়ে কর্নেল অরেলিয়ানোতে পরিণত হলেন; তুখোড় আর বিখ্যাত বিদ্রোহী যোদ্ধা। তবে শেষ বয়সে ফিরে গেলেন ঘরে সোনার মাছ তৈরিতে। মগ্ন থাকলেন ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবার আগে পর্যন্ত। ধীরে ধীরে মাকোন্দো একটি রূপকথার গ্রাম থেকে পরিণত হয় কোলাহলপূর্ণ নগরে। নিযুক্ত করা হয় নতুন মেয়র। মোটাদাগে একশো’র বেশি বছর জুড়ে বুয়েন্দিয়া বংশের জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, যৌনতা কিংবা বিয়ের মতো বিষয়াদি বিবৃত হয়েছে। তাদের কেউ ছিল নিষ্ঠুর, উদ্দাম, কামুক এবং প্রায়শ পতিতার আশ্রয়মুখী। আবার কেউ ছিল শান্ত এবং নিঃসঙ্গ; বন্ধ কক্ষে সোনার মাছ তৈরি এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধারে মগ্ন। বংশের মেয়েরাও যে স্বাভাবিক ছিল, তা নয়। কেউ মাটি খেয়ে কাটিয়েছে সময়, কেউ হঠাৎ বাগানে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেউ হাত পুড়িয়ে ফেলে ঢেকে রেখেছে কালো কাপড়ে। প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধিমান হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার জীবনটা শেষ হয় আঙিনায় চেস্টনাট গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায়। অনেকটা মস্তিষ্কবিকৃত হিসেবে। উরসুলা ছিল সারাটা জীবন পরিবারের প্রতি যত্নশীল। ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসা এই বৃদ্ধা প্রথমবার যে সত্য দেখতে পেলো তা হলো, তার সাবেক ব্যস্ত জীবন তাকে দেখতে দেয়নি কিছুই।

তবে গোটা পরিবারকে আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায় পিলার তারানেরা নামক জনৈকা পতিতার চোখে দেখলে। গ্রামে নাগরিকতার ছোঁয়া লাগে। চালু হয় নতুন ট্রেন লাইন। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা যে সেখানে থাবা বসাবে, তা অনুমেয়। কুখ্যাত ব্যানানা ম্যাসাকারের কথা আনতেও ভুলে যাননি মার্কেস। ১৯২৮ সালের ৫ এবং ৬ই ডিসেম্বর কলম্বিয়ার সান্টা মার্টায় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির শ্রমিকদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩,০০০। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস বর্ণনায় মার্কেস লাতিন আমেরিকার সত্যিকার ইতিহাসকেও এভাবে টেনে এনেছেন। মুনাফালোভীদের চালানো গণহত্যায় মৃত্যুবরণ করে তিন হাজার শ্রমিক; একরাশি রহস্যজনক অকালমৃত্যুর পর একদিকে বুয়েন্দিয়া পরিবারের মেয়ে আমারান্তা উরসুলা চলে যায় বাইরে পড়তে। বিয়ে করে ফেলে সেখানকার আধুনিক এক ছেলেকে। নিজের গ্রামের অগ্রগতির জন্য স্বপ্ন দেখার অভ্যাস তার। আর অন্যদিকে বুয়েন্দিয়া বাড়িতে তখন একমাত্র নিঃসঙ্গ মেধাবী পুরুষ অরেলিয়ানো। ঘরে বসে পূর্বপুরুষের মতো মেলকিয়াদেসের দেয়া পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার ও সোনার মাছ তৈরিতে বিভোর। বুয়েন্দিয়া বংশের ইতিহাস এখান থেকে বদলে যেতে পারতো। হয়ত গিয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি আমারান্তাকে কেবল গ্রামেই টেনে আনে না, প্রেমে ফেলে অরেলিয়ানোর। ষষ্ঠ প্রজন্মের পুরুষ অরেলিয়ানো পাণ্ডুলিপির অর্থ বের করতে পারে একসময়। শত বছর আগে মেলকিয়াদেসের লেখা পাণ্ডুলিপির। যখন সে দেখতে পায় তার সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটিকে মৃতাবস্থায় শুকনো থলের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ারা। বিষয়টা তাকে মনে করিয়ে দেয় মেলকিয়াদেসের লেখার তাৎপর্য— ‘বংশের প্রথমজন বাঁধা রয়েছে গাছের সঙ্গে এবং শেষজন যাচ্ছে পিঁপড়ার পেটে’। পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার শেষ হবার সাথে সাথেই আসে উষ্ণ বাতাস; শিহরিতো অরেলিয়ানোর সামনে একে একে স্পষ্ট হয় তার পূর্বপুরুষদের প্রতিটি ঘটনা আর তার সাথে মিলে যাওয়া মেলকিয়াদেসের সংস্কৃত ভাষায় লেখা ভবিষ্যদ্বাণী। প্রতিটি খুঁটিনাটি তথ্য এমনকি প্রমত্ত প্রেমের সঙ্গিনী আমারান্তা যে আসলে তার খালা—সেটাও। দেখতে পারে আশীর্বাদ আর অভিশাপে একটা বংশের উত্থান এবং পতন। তবে সে জানাতে কোনো লাভ নেই। অরেলিয়ানোর জন্য পালানোর সমস্ত পথ বন্ধ।

“ঘরটা ছেড়ে বের হওয়া সম্ভব না। কারণ অরেলিয়ানোর ঠিক যে মুহূর্তে পার্চমেন্টের অর্থ বের করা শেষ হবে, সেই মুহূর্তেই শহরটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে উষ্ণ বাতাস। মুছে দেবে মানুষের স্মৃতি থেকে। পরবর্তীকালে আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না ওই লেখার। কারণ নিঃসঙ্গতার একশ বছরে সাজা পাওয়া জাতিগুলোর জন্য দ্বিতীয় আর কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।” (নিঃসঙ্গতার একশ বছর, অনুবাদ- জি এইচ হাবীব)

গল্পের শুরুটা ছিল বাহ্যিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এক মাকোন্দোকে দিয়ে। মাঝখানে বিদ্রোহ, খুন, রাজনীতি, পুঁজিবাদ, প্রেম ও যৌনতা ঘটিত টানাপড়েন, অস্তিত্ব-সংকট প্রভৃতি জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। আবার শেষটা ঠিক আগের মতোই এক নিঃসঙ্গ জনহীন বিচ্ছিন্ন মাকোন্দো।

জাদুবাস্তবতার উপস্থিতি

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’ উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য হলো জাদুবাস্তবতা, যা বাস্তবতার সাথে অলৌকিকতা এবং কল্পনার মিশ্রণ ঘটায়। এই উপন্যাসে মার্কেস বাস্তব পৃথিবীর ঘটনাবলি এবং তাদের মধ্যে অসম্ভব বা অলৌকিক উপাদানগুলোকে এমনভাবে একীভূত করেছেন যে, পাঠক সহজে দুইয়ের মধ্যে বিভেদ করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, বুয়েন্দিয়া পরিবারের সদস্য, আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন একদিন একে একে একসাথে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেয়, তখন তার রক্তের সাথে মিশে যায় এক রহস্যময় সোনালি গুঁড়া, যা তাকে প্রায় অবিরাম শ্রেষ্ঠত্বের দিকে নিয়ে যায়। একইভাবে, উরসুলা, যিনি পরিবারের সবার মাতার মতো ছিলেন, স্বপ্নের মাধ্যমে একটি ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস দেন, যা বাস্তবতার সাথে মিশে যায়। এই ধরনের অলৌকিক ঘটনাগুলি উপন্যাসে একে অপরের সাথে মিশে বাস্তবতার চেয়ে গভীর কিছু দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, এর সবচেয়ে বিশেষ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হলো রেবেকা বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুর পর তাকে জীবিত করে তোলার ঘটনা। এখানে মৃত্যু এবং জীবনের মাঝে অদৃশ্য সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়েছে, যা মানবিক আবেগের এক অসীম আবেগের প্রকাশ। এসব ঘটনা উপন্যাসের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লিখিত। প্রেম, ক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীকী চিত্র। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে প্রেম, ক্ষমতা, এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রতিটি স্তরে বিশালভাবে উঠে এসেছে। এখানে প্রত্যেকটি চরিত্রের জীবনেই রয়েছে ব্যক্তিগত সংগ্রাম, অতীতের দুঃখ, এবং একটি অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা, যা তাদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন প্রথম প্রেমে পড়ে, তখন তার প্রেমের গভীরতা এবং তা থেকে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব তাকে এক বিচিত্র যাত্রার দিকে নিয়ে যায়। এই প্রেমের টানাপড়েন একদিকে তাকে সুখী করে, অন্যদিকে তাকে বিপদে ফেলে। আউরেলিয়ানো এবং পেত্রোনিলা-এর সম্পর্কও এমনই, যেখানে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক গভীরে চলে যায় এই দুটি চরিত্রের তিক্ততা এবং প্রেমের সংঘর্ষ। আউরেলিয়ানো এবং তার প্রেমিকা পেত্রোনিলার মধ্যে এক বিপর্যয়জনক সম্পর্কের মধ্যে যা উঠে আসে, তা হলো প্রেমের অধিকার, যা তাদের কষ্টকর এক অস্তিত্বে পরিণত হয়। একইভাবে, ক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগ রয়েছে, যেমন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, যিনি প্রথমে বুয়েন্দিয়া পরিবারের ভিত্তি স্থাপন শুরু করেন, কিন্তু একসময় নিজেকে অত্যন্ত পাগল অবস্থায় আবিষ্কার করেন, যেখানে তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার প্রতি আগ্রহ তাকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে। তার আধ্যাত্মিক পরিণতি পরিবারের পতনের একটি বিশাল চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

মানবিক ইতিহাস এবং শাশ্বত সত্য

মার্কেসের এই উপন্যাস শুধু একটি কাল্পনিক কাহিনি নয়, বরং এটি মানব ইতিহাস এবং মানুষের অভ্যন্তরীণ যাত্রার এক শাশ্বত চিত্র তুলে ধরেছে। এটি আসলে মানুষের জীবনের শাশ্বত সত্য—প্রেম, মৃত্যু, যন্ত্রণা, ক্ষমতা এবং দ্বন্দ্বের এক অতিক্রমী চিত্র তুলে ধরে আমাদের সামনে। যেমন, উপন্যাসের শেষদিকে বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস যখন শেষ হয়ে আসে, তখন পরিবারটি তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের এক অদৃশ্য ভবিষ্যতে পৌঁছায়।

এ উপন্যাস মানব ইতিহাসের শাশ্বত সত্যের প্রতীক। “In a world where the line between reality and imagination blurs, what is real? What is truth?”— উপন্যাসের শেষে, যখন বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস শেষ হয়, এটি পৃথিবীর চিরন্তন চক্রের মতো প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়—এখানে সব কিছু শেষ হতে হতে আবার নতুনভাবে ফিরে আসে।

মার্কেসের এই উপন্যাস পাঠককে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মানব জীবন, ইতিহাস এবং আবেগের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করে। বুয়েন্দিয়া পরিবারের জীবন—যেখানে প্রেম, ক্ষমতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম এবং হতাশা একসাথে মিশে গেছে, তা সত্যিই চমকপ্রদ।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত