Homeসাহিত্যহার্ট ল্যাম্প ।। বানু মুশতাক

হার্ট ল্যাম্প ।। বানু মুশতাক


বানু মুশতাক (জন্ম: ১৯৪৮) ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের কন্নড় ভাষার লেখক। ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প-এর জন্য তিনি এবছর আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ লাভ করেন। বুকারের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ছোটগল্প সংকলনকে এই সম্মানে ভূষিত করা হলো।

আধ-বোজা দরজাটা ঠেলে মেহরুন ঘরের ভেতরে এক পা দিতেই, বসার ঘরের নিচু খাটে শুয়ে থাকা তার আব্বা এবং পাশে বসে নিচু স্বরে আলাপরত তার বড় ভাই—দুজনেই কথা থামিয়ে মেহরুনের দিকে তাকালো। ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভাইঝি, রাবেয়া, ভেতর ঘর থেকে দৌড়ে তার কাছে এলো, আর আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে খলবল করে সারা বাড়ি জানিয়ে দিলো যে, ‘মেহরুন ফুফু এসেছে! মেহরুন ফুফু এসেছে!’ রাবেয়ার বাবা, তার মেজ ভাই আম্মান, গালে শেভিং ক্রিম মাখানো, হাতে শেভিং ব্রাশ ধরা অবস্থায় নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মেহরুনের দিকে এমন আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালো, যেন সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার বড় আপা, আথিগে, আরেক ঘরে বাচ্চাদের সুর করে কোরআন পড়তে শেখাচ্ছিল। আপা দ্রুত পায়ে বসার ঘরে এসে মেহরুনের দিকে তাকালো। শাড়ির আঁচল দিয়ে করা ঘোমটা কখন যে মাথা থেকে সরে গেছে, সে ব্যাপারে আপার কোনো খেয়াল নেই। শীর্ণ দুহাতের পাতলা পাতলা আঙুলে তসবি ধরে রাখা তার মা হতবাক ও হতভম্ব হয়ে স্নায়ু বৈকল্যের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন জিজ্ঞেস করছে, ‘এটা কি সত্যি?…এটা কি সত্যি!?’ মেহরুনের ছোট দুই বোন, রেহানা ও সাবিহা বসার ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিলো। ওরা দুজন রান্নাঘরে চাপাতি-রুটি বানাচ্ছিল, চাপাতি তাওয়ায় লেগে পুড়ে কয়লা হলে হোক! সৌভাগ্যক্রমে তার ছোট ভাই আতিফ তখন বাসায় ছিল না।

পুরো বাড়ি মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ ও নীরব হয়ে পড়লো।

ব্যাপারটা তার কাছে অস্বাভাবিক ও অচেনা মনে হলো। যে মা তাকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করেছে, তাকে বড় করেছে, সেই মা তো বললো না—‘এসেছিস! আয় রে, ভেতরে আয় মেয়েটা!’ আর যে বাবা নিজ চওড়া বুকে ছোট্ট মেহরুনের পায়ের দাপাদাপিতে পুলকিত-আহ্লাদিত হতো, সেই বাবা তাকে স্বাগত জানিয়ে এক চিলতে হাসিও হাসলো না! তাকে সবসময় ‘আমার পরি, আমার অ্যাঞ্জেল’ বলে ডাকা তার বড় ভাই, কিংবা তাকে অবশ্যই কলেজে পড়তে পাঠাতে হবে, এ ব্যাপারে সবচেয়ে জোর দিয়ে বলা তার মেজ ভাই, আম্মান, কেউ তাকে কোনোপ্রকার সম্ভাষণ জানালো না। দুই ভাইয়ের বউরা তার দিকে এমন বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে, যেন সে অন্য কোনো গ্রহ থেকে নেমে এসেছে।

মেহরুনের ভেতরটা ‘ধক’ করে ওঠে! তার কোলে নয় মাস বয়সী কন্যার আচমকা এক তীক্ষ্ম চিৎকারের পরই কেবল তারা তাদের বিহ্বল আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসে। বড় ভাই তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ইনায়েত কোথায়?’

মেহরুন এমনভাবে মাথা ঝোকায়, যেন সে একটা অপরাধ করে ফেলেছে। মাথা নিচু রেখেই সে বলে, ‘সে শহরে নেই।’

‘তাহলে তুই কার সাথে এসেছিস?’

‘আমি একা এসেছি।’

ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সে সবার উচ্চকিত-বিস্মিত সমস্বর শুনতে পায়, ‘একা?!’

‘ফারুক, ওকে ভেতরে নিয়ে যা।’

বড় ভাই নির্দেশ দিতেই মেহরুন ভারী ও টলটলায়মান পায়ে বসার ঘরে ঢোকে। ঘরটা তার কাছে আদালতের মতো মনে হয়। তার মেয়েটা আবার চিৎকার করে। বোরকা না খুলেই সে তার নেকাব উঁচিয়ে, শরীর-মুখ ঘুরিয়ে আড়াল তৈরি করে বাবার বিছানার ওপর তেরচা হয়ে বসে মেয়ের ঠোঁটে একটা স্তনের বোঁটা লাগিয়ে দেয়। নিজের মুখটাও ধোয়া হয় না তার। বাচ্চার স্তন্যের টানে টানে তার পেট জ্বলতে থাকে। গতরাত থেকে এখনো পর্যন্ত কিছুই খায়নি সে। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর এই সময়টুকুতে তার মা বাদে অন্য কারোর উপস্থিত থাকার কথা নয়, থাকতে পারে না।

‘মেহের, এখানে আসার আগে বাসার কাউকে জানিয়ে এসেছিস?’

‘না।’

‘কেন?! আসার আগে কাউকে কিছু জানাসনি কেন? তুই দেখছি আমাদের ওপর গজব নামিয়ে আনার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিস।’

‘তা কাকে বলে আসতাম আমি? ওখানে আছেটা কে? আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল সে শেষবার বাড়ি ফিরেছিল। আমাকে বলেও যায়নি কোথায় যাচ্ছে। আমি তোমাদের সবাইকে লিখে জানিয়েছি, জানতে চেয়েছি; কিন্তু তোমরা কেউ কোনো উত্তরই করোনি। আমি মরে গেছি, নাকি বেঁচে আছি, সে ব্যাপারে কোনো চিন্তাই করোনি!’

‘তুই লিখেছিস, তোর স্বামী নাকি কোনো এক নার্সকে নিয়ে ভেগেছে। আচ্ছা, তুই কি আমাদের একথা বিশ্বাস করতে বলিস?’

‘আমার কথা যদি তোমরা বিশ্বাস না-ই করো, তাহলে অন্তত আমার ওখানে গিয়ে ব্যাপারটা তোমাদের জেনে-বুঝে আসা উচিত ছিল। অনেকেই ওদের দুজনকে একসাথে দেখেছে।’

‘তা, আমরা তোর ওখানে গিয়ে, ওকে দেখে কী করতাম, শুনি? ধর, ওকে হাতেনাতে ধরেই ফেললাম, আর এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম; আর আমাদের মুখের ওপর ও বলেই ফেললো যে, হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যি। তখন আমরা কি করতাম? আমরা কি সালিশ-বিচারের জন্য মসজিদে দরখাস্ত করতাম, আবেদন দাখিল করতাম? ও তখন বলতো যে, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে; আগে ওকে আমি মুসলমান বানাবো, তারপর ওকে নিকাহ করবো। আর তখন সেই মহিলা তোর সতিন হয়ে যেতো। আর ধর, তখন আমরা ওকে আরো বকাঝকা করলাম, দোষারোপ করলাম; তখন যদি ও বলে বসে যে, ‘আমি মেহরুন নামের এই মহিলার সাথে থাকতে চাই না, আমি ওকে তালাক দেবো… তালাক?’

ততক্ষণে মেহরুন প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মেয়েটির ঠোঁটে আরেক স্তন ধরিয়ে দিয়ে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বোরকার নিচ থেকে আঁচল টেনে বার করে এনে সে তার চোখ-নাক মোছে।

তাদের কয়েক মুহূর্তের নীরব-নিশ্চলতা।

‘তার মানে, তোমরা কেউ কোনোকিছু করার অবস্থায় নেই, তাই তো?’

কেউ কোনো কথা বলে না। মেহরুন বলে চলে, ‘আমি তোমাদের পায়ে পায়ে পড়ে বলেছিলাম, অনুনয়বিনয় করেছিলাম যে, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। তোমরা কি শুনেছিলে আমার কথা? আমি বলেছিলাম—আমি বোরকা পরবো, আর কলেজে যাবো। আমি ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে তোমাদের কাছে আকুলভাবে বলেছিলাম—আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিও না! কিন্তু তোমরা কেউ আমার কোনো কথা শুনলেই না। আমার অনেক বান্ধবী-সহপাঠিরা এখনো বিয়েই করেনি; অথচ আমি পুরোপুরি বুড়ি হয়ে গেলাম। আমার ওপর পাঁচ পাঁচটা সন্তানের বোঝা। ওদের বাপ ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে ‘মুখ’ দিচ্ছে, ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, আর এদিকে আমার নিজের জীবন বলে কিছু নেই। একটা লোক যখন এসব হারাম কাজ করে চলে, তোমাদের কারো কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই যে, তাকে জিজ্ঞেস করে—কেন সে এসব করে বেড়াচ্ছে?’

‘যথেষ্ট বকেছিস মেহের, অনেক হয়েছে!’ ওর মা দুচোখ বন্ধ করে দুঃখ-কষ্টে নিজের মাথা ঝাঁকাতে থাকে।

‘হ্যাঁ, আম্মা, আমিও অনেক সহ্য করেছি। প্রথম প্রথম লোকজন ফিসফিসানি শুরু করলো; তারপর সবাই দুজনকে একসাথে থিয়েটার-সিনেমায় যেতে দেখলো, হোটেলে যেতে দেখলো। ওরাই সরাসরি এসে আমাকে সব জানিয়ে গেল। এরপর তো তার সাহস আরো বেড়ে গেল—মেয়েটার বাড়ি যাওয়া-আসা শুরু করলো। তখন সবাই ওকে বকাঝকা শুরু করলে, বাড়ি ছেড়ে সোজা ব্যাঙ্গালুর চলে গেল। ওখানে হাজার হাজার রুপি ওড়ালো, আর সেই মেয়েটাকে ব্যাঙ্গালুর বদলি করিয়ে নিলো। আর এই গত আটদিন ধরে ও সেই মেয়ের সাথে একসাথে থাকছে। আর কতদিন এসব আমি সহ্য করবো, বলো তো? কীভাবে বাঁচবো আমি?’

‘ধৈর্য ধর মেয়ে, ধৈর্য রাখ। ভালোবেসে, ভালোবাসা দিয়ে ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর।’

‘আচ্ছা আম্মা, আমার নিজের হৃদয় বলতে কি কিছু নেই? আমার কি কোনো অনুভূতি নেই? যখন ও এভাবে ভেগে গেল, তখন ওকে আমি আর আমার স্বামী হিসেবে সম্মান করতে পারি না। এখন ওকে দেখলেই আমার পুরো শরীর-মন নিদারুণ ঘৃণা আর বিরক্তিতে ভরে ওঠে। সেখানে ভালোবাসা তো দূরের কথা! এখন এটা আর তার আমাকে তালাক দেবার বিষয় নয়; আমিই ওর কাছ থেকে তালাক নিয়ে নেবো। আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি না।’

‘এসব তুই কি বলছিস, মেহের?! অনেক বাজে বকছিস তুই। ও একটা পুরুষ মানুষ। হ্যাঁ, এখন হয়ত হোঁচট খেয়ে নোংরা-কাদার মধ্যে পড়েছে; কিন্তু দেখিস একটু পানি পেলেই সব নোংরা ঝেড়ে-মুঝে নেবে; আবার ফিরে আসবে। কোনো নোংরা দাগ ওর গায়ে লেগে থাকবে না।’

মায়ের কথার পর, সে কিছু বলার আগেই মেজ ভাই আম্মান বলে ওঠে, ‘দেখো! আমাদের সামনে ও কী আচরণ করছে, একবার দ্যাখো! নিশ্চয়ই ও ঠিক এভাবেই ওর স্বামীর সাথে কথাবার্তা বলেছে। আমি নিশ্চিত লোকটা একারণেই রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে।’

আম্মান এরপর তার কণ্ঠস্বর সামান্য নমনীয় করে শেষ বাক্যটা যোগ করে, ‘এই বাড়ির পূত্রবধুরা যদি তোর কাছ থেকে এসব শেখে, তাহলেই, ব্যাস! হয়েছে আর কি!’

একথা শুনে মেহরুনের দুঃখ-কষ্ট সাথে সাথে রাগে পরিণত হয়; তারপর সেই রাগের রূপান্তর ঘটে হতাশায়। ‘ভাইয়া, আপনি যুক্তি-তর্ক ভালোই পারেন। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন। একথা তো সত্যি যে, আমিই আসলে খারাপ। আর এখন আমি আমার খারাপ আচার-আচরণগুলো জেনে গিয়েছি; খারাপ স্বভাব-প্রবৃত্তিগুলো বুঝে গিয়েছি। আমি বোরকা ছাড়া কখনো বাইরে বের হই না। ও আমাকে বোরকা পরা বাদ দিতে বলেছিল। নাভির নিচে শাড়ি পরতে জোর করতো; আর ওভাবেই ওর হাত ধরাধরি করে সদর্পে-সদম্ভে ঘোরাফেরা করতে বলতো। কিন্তু আপনারা আমাকে বোরকায় আবৃত করেছেন আর এমনভাবে প্রতিপালন করেছেন যে, মাথার উপর থেকে শাড়ির আঁচলের ঘোমটাটাও আমি পড়ে যেতে দিই না, তাই না ভাইয়া? এখন মাথা থেকে ঘোমটা খুললেই আমার নিজেকে কেমন যেন ‘ন্যাংটো’ লাগে। আপনি আমার অন্তর আল্লাহ-ভীতি ও আল্লাহ-প্রীতি দিয়ে ভরিয়ে তুলেছেন। তাই, আমার স্বামী যেটা চেয়েছিল, যেমনটা চেয়েছিল আমি তেমন তেমনটা করতে রাজি হয়নি। এখন তার সুরে নাচে, তার তালে বাজে—এমন একজনকেই সে বেছে নিয়েছে। আর এদিকে তোমরা সবাই এই ভয়ে আছো যে, ও যদি আমাকে তালাক দেয়, ছেড়ে দেয়, তাহলে আমি আর আমার সন্তানেরা তোমার ঘরের বোঝা হয়ে দাঁড়াবো। সে কারণেই তোমরা আমাকে পরিস্থিতি মানিয়ে নিয়ে সেখানে থাকতে বলছো। কিন্তু সেটা এখন আর সম্ভব নয়। ঐ জ্বলন্ত নরকে পোড়ার চেয়ে আমি আমাদের সন্তানদের নিয়ে বেরিয়ে আসবো। কোথাও কোনো কুলি-মজুরের কাজ করে জীবনটা চালিয়ে নেবো। তোমাদের কারোর উপর কোনো বোঝা হবো না আমি।…না; একদমই বোঝা হবো না!’

‘লতানো গাছের ফল কি আর গাছের জন্য বোঝা হয় রে মা, মেহের?’ তুই আর আবোল-তাবোল বকিস না,’ মা আপত্তির সুরে বলে।

‘আম্মা, ওকে ভেতরে নিয়ে যান, আর কিছু খেতে দিন,’ গম্ভীরভাবে ওর বড় ভাই বলে। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে চিকমাগালুর রওনা হচ্ছি। বাস পেয়ে গেলে বাসে যাবো; না পেলে ট্যাক্সি নিয়ে। আমরা তো আর ওর সুরে সুরে নাচানাচি করে যেতে পারি না!’

‘আপনার বাড়িতে আমি এক ফোঁটাও পানি স্পর্শ করবো না! আর আমি চিকমাগালুরও ফিরে যাবো না। আপনি যদি জোর করে আমাকে নিয়ে যান, তাহলে এই আমি কসম খেয়ে কেটে বলছি—আমি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে মরবো!’

“তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস, মেহের! যারা মরতে চায়, আত্মহত্যা করতে চায়, তারা ‘মরবো মরবো’ বলে বকে বকে বেড়ায় না। কিন্তু তোর যদি এই পরিবারের মান-সম্মান নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ-চিন্তা থাকতো, তাহলে এখানে চলে আসার বদলে তুই তা-ই করতিস! যে বাড়িতে ডোলি (বধূযাত্রা) গিয়েছে, যেখান থেকেই তোর ডোলা (শবযাত্রা) বের করা উচিত। সতী-সাধ্বী নারীর জন্য এটাই জীবন। তোর একটা মেয়ে হাই স্কুলে পড়ে; এদিকে তোর ছোট দুটি বোন আছে, যারা এখন বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছেছে। তোর একটা ভুল কাজ, একটা ভুল পদক্ষেপ কিন্তু ওদের ভবিষ্যৎ, ওদের জীবন নষ্ট করে দিতে পারে। তুই বলছিস যে, তোর ছেলেমানুষি কথা আমাদের মানতেই হবে, আর তোর বাড়িতে গিয়ে তোর স্বামীর সাথে ঝগড়া-মারামারি করে আসতে হবে। কিন্তু আমাদেরও তো স্ত্রী-সন্তান আছে, না কি?! এখন ভেতরে যা, আর কিছু একটা খেয়ে নে।”

বড় ভাই এরপর মেজ ভাইয়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, ‘আম্মান, দৌড়ে যা, একটা ট্যাক্সি নিয়ে আয়।’ তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর তুই, তোর ছেলেমেয়েরা কিংবা পাড়া-প্রতিবেশিরা যদি জিজ্ঞেস করে, তাহলে ওদের বলবি যে, বাচ্চাকে নিয়ে তুই হাসপাতাল গিয়েছিলি, বা এই ধরনের একটা কিছু।…এখানে আসার জন্য বাড়ি থেকে কয়টায় বেরিয়েছিলি, বল্ তো?’

মেহরুন কোনো উত্তর দেয় না।

‘এখন বাজে সাড়ে নয়টা,’ আম্মান বলে ওঠে, ‘ও এসেছে নয়টার সময়। তিন ঘণ্টার যাত্রা; ও তাহলে সকাল ছয়টায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। আর আমরা যদি এখুনি বেরিয়ে পড়তে পারি, তাহলে সাড়ে বারোটার দিকে ওখানে পৌঁছে যাবো।’

মেহরুন তার জায়গায় থম মেরে বসে থাকে। তার মা আর ছোট দুবোন পালা করে তাকে কিছু খেয়ে নিতে অনুনয়বিনয় করে; কিন্তু সামান্য একটু খাবার বা এক ফোঁটা পানিও সে মুখে তোলে না। ট্যাক্সি হাজির হলে সে কারোর সাথে কোনো কথা না বলে কোলের মেয়েকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। তার দুই পাশে দুই বড় ভাই। মেহরুন কাউকে কোনো সালাম বা বিদায় সম্ভাষণ জানায় না। শুধু শেষ কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাবার পর, পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার বাড়িটাকে চোখের মধ্যে পুরে নিতে চায়—যে বাড়িতে সে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে। তার চোখ অশ্রু ছলছল করে ওঠে। ওর আব্বা বুকে হাত চেপে ধরে কাশছে, কেশে চলেছে। ওর আম্মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পরমুহূর্তে স্বামীর দিকে ঘুরে স্বামীকে পুরোপুরি শুইয়ে দিলো। 

স্বামীকে বাতাস করতে করতে, মুখে-মাথায় পানির ছিটা দিতে দিতে নিজেকে শোনানোর মতো করে বলে আম্মা বললো, ‘হে, আল্লাহ, আমি যদি সামান্য এতটুকুনও পুণ্য অর্জন করে থাকি, আমার সমস্ত জীবনভর এতটুকুন সদ্গুণ, এতটুকুন সওয়াব—তাহলে তার বিনিময়ে তুমি আমার মেয়ের জীবনটাকে ঠিক করে দাও; একটা সুব্যবস্থা করে দাও… আল্লাহ!’

ট্যাক্সির দরজা খুলে, আম্মান চোখের ইশারায় মেহেরকে ভেতরে ঢুকে বসতে বলে। শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক তালের আড়ালে মেজ ভাই গজগজ করে চলেছে। অথচ একসময় মেহেরুন তার ভাইদের নিয়ে কী যে গর্ব-অহংকার করতো, বড়াই করতো! তার স্বামী ইনায়েতের সাথে মনোমালিন্য হলে রাগ করে সে বলতো, ‘আমার ভাইয়েরা কিন্তু শের-ই বাব্বারের মতো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি যদি এমন আচরণ করতে থাকো, তাহলে ওনারা একদিন তোমাকে ধরে ছিঁড়ে-কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে; হুঁশিয়ার!’ কিন্তু সেই গর্ব, সেই দম্ভ-অহংকার এখন পুরোপুরি মুছে দিয়েছে। তার ভাইয়ের একটু আগের কথা তার কানে গুঞ্জরিত হতে থাকে— ‘তোর যদি আমাদের পরিবারের মান-সম্মান নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ-চিন্তা থাকতো, তাহলে এখানে চলে আসার বদলে তুই নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে মরেই যেতিস। তোর এখানে আসাটা মোটেই উচিত হয়নি।’

গাড়িতে ওঠার সময় সে ফের তার বাড়ির দিকে তাকালো না; তাকালে দেখতে পেতো—আম্মা একটা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে; দেখতে পেতো—ছোট দুই বোন পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে তার দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে। অবশ্য, তার ভাবীদের সে হয়ত সেখানে দেখতে পেতো না; তারা সম্ভবত ঘর-দোরের দৈনন্দিন কাজেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তবু নেকাবের অন্তরালে তার দুগাল বেয়ে ঝরনাধারার মতো অশ্রু ঝরতে লাগলো। দুঠোঁট আঁকড়ে-কামড়ে ধরে সে তার ছোট ছোট ফোঁপানি-কান্নার টুঁটি চেপে ধরলো।

দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটে চলে; কেউ কোনো কথা বলে না। আম্মান ভাই সামনের সিটে, মহল্লার ড্রাইভারের পাশে বসেছে। তার সামনে কি আর পারিবারিক গোপন বিষয় আলোচনা করা যায়? সুতরাং তাদের দীর্ঘ যাত্রা নীরবভাবে চলতে থাকে।

আজ ষোল বছর ধরে সে ইনায়েতের প্রেম-ভালোবাসা আর লোভ-লালসার গুটি হয়ে আছে। আর এই ষোল বছরের মাথায় এসে লোকটা তার নারীত্বকে, তার নারীসত্তাকে অপমান করেছে। ‘তুমি তো একটা লাশের মতো পড়ে আছো; তোমার কাছ থেকে কোন সুখটা আমি পেলাম?’ ইনায়েত তাকে খুঁচিয়েছিল। ‘খাওয়া-পরার কিছু কি বাকি রেখেছি তোমাকে দিতে? এখন আমাকে কে থামায় দেখি! আমি এখন যে মেয়েটার সাথে আছি, সে আমাকে সুখ দিয়েছে, সুখী করেছে!’

যাত্রাপথে সে রাস্তাঘাট, দুপাশের গাছপালা কিংবা অন্য কোনো দৃশ্যও খেয়াল করে দেখে না। শুধু, ট্যাক্সিটা যখন ব্রেক কষে আচমকা থেমে গেল, সে উদাসীনভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে যেটা দেখলো, সেটাকে ওরা সবাই ‘মেহরুনের বাড়ি’ বলে।

সদর দরজা থেকে শুকনো মুখের এক কিশোরী ‘আম্মি আম্মি’ বলে দৌড়ে গাড়ির কাছে চলে আসলো। ‘তুমি শেষমেশ ফিরলে! আমি যে কী উদ্বিগ্ন হয়ে ছিলাম,’ বলে মেয়েটা মায়ের কোল থেকে তার ছোট্ট বোনটাকে দুহাতে তুলে, বুকে চেপে ধরে প্রায় দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।

মেহরুন ধীর পায়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। বাচ্চারা সবাই স্কুলে গিয়েছে। বাড়িটা তাই খাঁ-খাঁ করে, ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। তার ষোলো বছর বয়সী মেয়ে সালমা—যে তার মায়ের দুঃখ-দুর্দশার একমাত্র ভাগীদার—সেই সালমাই আজ বাড়ির সবচেয়ে বড়। সালমা তার ভাই-বোনদের গুছিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে, মায়ের ফিরে আসা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সারাটা সকাল পার করেছে। মা-র সাথে দুই মামাকে দেখে সে উতলা-উদ্দীপিত হয়ে পড়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মামারা নিশ্চয় ঐ মহিলাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বের করে দেবে, এমনটা সে ভাবে। সে চঞ্চলা হরিণীর মতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করে; মামাদের জন্য নাস্তার আয়োজন করে, চুলায় চা বসিয়ে দেয়।

মেহরুন নিজের ঘরের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। সালমা মায়ের কাছে গিয়ে, মায়ের গাল থেকে অশ্রু মুছে দিয়ে, মাকে কয়েক গাল খাবার খাইয়ে দেয়। এরপর, এঁটো খাবারের থালা হাতে করে ঘর থেকে বের হতেই, বাড়ির মধ্যে একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পায়।

সে দৌড়ে আবার মায়ের ঘরে ঢোকে। ‘আম্মি, আম্মি, আব্বা এসেছেন!’

মেহরুন না শোনার ভাব করে; যে কম্বল সে গায়ে জড়িয়েছিল, তার আরো ভেতরে নিজেকে সে ঢুকিয়ে নেয়। তার মাথার সব স্নায়ু, শিরা-উপশিরা কাঁপছে, ধুপধাপ করে লাফাচ্ছে।

সালমা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে আসে। মামারা সামনের উঠানে দাঁড়িয়েছেন। ওখান থেকে ভেসে আসা পুরুষদের কণ্ঠ ও কথাবার্তা সে পরিষ্কার শুনতে পায়। সালাম বিনিময়, হাসি, কথোপকথন।

‘আরে ভাইয়া! আপনারা কখন এলেন?’ ইনায়েত জিজ্ঞেস করলো।

‘এই তো, এখুনি এলাম। তুমি কেমন আছো?’

‘আল্লাহর রহমত আর আপনাদের দোয়ায় আমি ভালোই আছি।’

আম্মান মামার কণ্ঠ শোনা যায়—‘আপনি কোথায় ছিলেন ইনায়েত ভাই?’

‘এইতো, এখানেই! এটা-ওটা কিছু খুচরো কাজ ছিল; করে বেড়াচ্ছিলাম। আপনি তো এসব বোঝেনই। ঘুম থেকে উঠে আমরা তো আর অলস ঘরে বসে থাকতে পারি না!’

ইনায়েত এবার একটা হাঁক ছাড়ে—‘সালমা! সালমা! তোর আম্মি কোথায়? দেখ্ কারা এসেছেন! আম্মিকে বাইরে আসতে বল্।’

বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ ভেসে আসে না। ‘কী জানি, কোথায় কী করছে ও,’ ইনায়েত বলে, ‘নিশ্চিত, বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘরের মধ্যেই আছে। ভাইয়া, একটু দাঁড়ান, আমি ডেকে আনছি।’

বসার ঘরে ঢুকেই সালমাকে দেখে ইনায়েত স্বর নামিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই, এরা এখানে কখন এসেছে রে? আর তোর আম্মি কোথায়?’ ইনায়েতের মনের মধ্যে সন্দেহের সুতো খুলতে-খেলতে শুরু করে দিয়েছে।

‘মামারা এইমাত্র এসেছেন। আর আম্মি এখনো ঘুমাচ্ছে,’ সালমা একটু চালাকি করে বলে। ইনায়েত স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।

‘তোর আম্মি এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি? কী হয়েছে কী ওর?’ বলে ইনায়েত শোবার ঘরের খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেহরুনের শরীর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য তাকে নিদারুণ বিরক্ত করে। যে একমাত্র যে বিষয়টার জন্য তার স্ত্রীর গুরুত্বের দাবি করতে পারে তা হলো, সে তার সন্তানদের মা, জন্মদাত্রী মা। ইনায়েত ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইলেও, তার দুই পা তাকে ভেতরে নিয়ে যায় না।

লোকটা কীভাবে, কী ভঙ্গিমায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, জেগে থাকা মেহরুন সেসব কল্পনায় দেখে। লোকটার পোশাক, তাতে সিগারেটের দুর্গন্ধ, শরীরে ঘামের উৎকট গন্ধ, লোকটার বুড়িয়ে আসতে থাকা শরীর, বড় বড় দুটি চোখ। যে লোকটা তার প্রতিটি স্নায়ুর উপর কষে দাগ কেটে গিয়েছে, সেই লোকটাই এখন তার কাছে অপরিচিত। কম্বল শক্ত করে চেপে মেহরুন যেভাবে শুয়েছিল, সেভাবেই সে স্বামীর কণ্ঠ শুনতে পায়।

‘সালমা, এদিকে আয়। তোর আম্মিকে এসব নাটক একেবারে বন্ধ করতে বল্। ও যদি আমাকে উপদেশ দিতেই ওর ভাইয়াদের এখানে এনেছে, তো নিজেই কিন্তু নিজের গলায় ফাঁস পরে নিয়েছে! এক শ্বাসে আমি এক দুই তিনবার ‘ওটা’ আওড়ে নেবো; আর এসব নাটক-ফাটক একেবারে খতম করে দেবো! তোর আম্মিকে গিয়ে বল্। আর বল্ যে, তালাক পাওয়ার পর ওর ছোট দুই বোন আর তোকে, আর তোর বোনদের কখনো বিয়ে দিতে পারে কিনা দেখতে। তোর আম্মিকে বল্, অতিথির সামনে সে আমার পারিবারিক সম্মানকে একেবারে ধুলোয় মিটিয়ে দিচ্ছে। গিয়ে বল্ তো, তোর আম্মিকে! তার ভাইদের সালাম জানিয়ে ভেতরে নিয়ে আসতে বল্; আর জিজ্ঞেস কর্, কী আনতে বলে—মুরগী নাকি খাসি। দুপুর তো প্রায় হয়েই গিয়েছে; তোর আম্মিকে জলদি জলদি দুপুরের খানা পাকাতে শুরু করতে বল্!’

সালমা মোটেই তার আব্বার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল না। কিন্তু ইনায়েত এমনভাবে গড়গড় করে তার যা বলার বলে যায়, যেন সালমা ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

যেন কিছুই হয়নি, ঘটেনি—এমন ভাব-ভঙ্গিতে ইনায়েত আর তার শালা-সম্বন্ধীরা কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা চালিয়ে গেল। তারা কফির মূল্য নিয়ে, কাশ্মীরের নির্বাচন নিয়ে, মহল্লার এক পৌঢ় দম্পতির হত্যাকাণ্ড ও তদন্ত নিয়ে কথা বললো। মহল্লার জনৈক মুসলমান মেয়ের তার হিন্দু প্রেমিককে আনুষ্ঠানিকভাবে সিভিল ম্যারেজ করা নিয়ে, আরো এটা-সেটা নিয়ে গল্পসল্প চালিয়ে গেল। একদিকে তাদের গল্প এগিয়ে চললো, অন্যদিকে প্রেসার কুকার সিটি মারতে লাগলো, ব্লেন্ডার গোঁ গোঁ শব্দে ঘুরতে লাগলো। মসলার ঝাঁঝালো গন্ধ বাতাসে ভর করলো; বাজার থেকে মুরগী আসলো। দুপুরের খাবার তৈরি হয়ে গেল; মেহরুন খেটে-খুটে একা হাতে সবকিছু রান্না করলো। আর সালমা খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেহরুন মাত্র একবার, তাও অল্প সময়ের জন্য রান্নাঘর ছেড়ে বেরোনোর ফুরসত পেয়েছিল।

দুপুরের ভারী ভোজন শেষে, মুখে পান ঠেসে-গুঁজে নিয়ে মেহরুনের বড় ভাইয়েরা বাড়ি ফেরার জন্য প্রস্তুত হলো। বেরিয়ে পড়ার আগে মেজ ভাই আম্মান রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু কথা যেন বাতাসে ছেড়ে দিলো: ‘একটু বুদ্ধিশুদ্ধি করে, চাতুরী করে সবকিছু ম্যানেজ করে চল্। আমি সামনের সপ্তাহে একবার আসবো। ও কিছুদিন এমন আচরণ চালিয়ে যাবে, তারপর সবকিছু শুধরে যাবে; নিজেই পথে চলে আসবে। তবে দায়িত্ব-দায়ভার কিন্তু তোকেই নিতে হবে। অনেক মেয়েদের তো কিছু কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতেই হয়—যাদের স্বামী মদ্যপ-মাতাল হয়, কিংবা যাদের শাশুড়ি গায়ে হাত তোলে, নির্যাতন করে। আল্লাহর শুকরিয়া তুই অনেক ভালো অবস্থায় আছিস! ইনায়েত খানিকটা দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বটে; কিন্তু ঐ অতটুকুই। তোকেই তো এসব সামলে-বুঝে, মানিয়ে চলতে হবে।’

ট্যাক্সি করে ভাইয়ারা ফিরে গেল। আর, গাড়ির শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যেতে না যেতে ইনায়েতও ঘর ছেড়ে ভাগলো।

সালমা ঘুরে আম্মির মুখের দিকে তাকায়। মামারা আম্মিকে কোনো সান্ত্বনাবাণী শোনায়নি, কোনোপ্রকার সাহায্যও করেনি। আম্মির দুঃখ-যন্ত্রণা তার ভেতরে কষ্টের ধুকপুকানি তৈরি করে। আব্বা যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তার দুচোখ ছলছল করে ওঠে। বিষাদ-নৈরাশ্যে বাড়িটা ডুবে থাকে। স্কুল থেকে ওর ভাইবোনের ফিরে আসার কোলাহলও সেই গুমোট নিরানন্দভাব দূর করতে পারে না।

যার যার নিজের কাজ আছে; বয়ে চলার জন্য যার যার নিজের বোঝা আছে। বিকেলে আলো ফুরিয়ে গিয়ে যখন সন্ধ্যা নামলো, সব ঘরে লস্ফ-প্রদীপ জ্বালানো হলো। কিন্তু মেহরুনের হৃদয়-প্রদীপ অনেক আগেই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। কীসের জন্য সে বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকার যুক্তিটা কী? এসব দেয়াল, ছাদ, চুলো, থালাবাটি, আসবাব ও বিছানাপত্র, তৈজসপত্র, বদনা-বালতি, সামনের উঠোনের গোলাপ গাছ—এসবের কোনোকিছুই তার প্রশ্নের কোনো উত্তর করতে পারে না। তাকে পাহারা দিয়ে চলা, তার চারপাশে ঘুরঘুর করে চলা ম্রিয়মাণ চোখদুটির দিকেও সে তাকায় না।

সালমা তার লেখাপড়া, বই খাতার মধ্যে ডুবে থাকতে চাইছিল; আসন্ন এস. এস. এল. সি পরীক্ষায় বসার জন্য নিজেকে তার প্রস্তুত করা দরকার। কিন্তু ভয়ানক এক উৎকণ্ঠা—যার নাম মুখেও আনা যায় না—সেই উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা নিয়ে সে তার আম্মিকে সবসময় চোখে চোখে রাখছে।

রাতের নীরবতার মাঝে মেহরুন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ যেন তারই জীবনের মতো নিকষ-ঘোর অন্ধকার। বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। এক সালমাই শুধু বসার ঘরে বসে পড়ালেখা করছে; আর মায়ের ঘরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।

মেহরুনের ঘুম পুরোপুরি হাওয়া হয়ে গেছে। সে ভাবতে থাকে: নিজের বাড়িতে তার যুদ্ধ-সংগ্রামগুলো কি খুব সহজ ছিল? বি. কম দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনালের একমাস আগে তার বিয়ে হয়ে যায়। অনেক কান্নাকাটি করে, ভীষণ আকুতিভরে বাড়ির মুরুব্বীদের কাছে সে পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু বাড়ির একজন মানুষও সে কথা কানে পর্যন্ত তুললো না। বিয়ের এক সপ্তাহ পর, দ্বিধা-সংশয়ভরে সে তার স্বামীর কাছে পরীক্ষায় বসতে চাওয়ার কথা উত্থাপন করেছিল। শুনেই, লোকটা হেসে উঠে তাকে ‘আমার ভালোবাসা, প্রেয়সী, আমার জান’—এসব আদুরে নামে ডেকে বলেছিল—‘এই সময়টা তুমি যদি এখানে না থাকো, তাহলে কি আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে না?’ মেহরুনও বিশ্বাস করে নিয়েছিল সে কথা; সে সাথে না থাকলে লোকটার জান বেরিয়েও যেতে পারে। তাই সে সুখী হয়েছিল। তখন থেকে সে স্বামীর সকল ইচ্ছাকে পূরণ করেছে, অনুসরণ করেছে। সে-ই ছিল লোকটার হৃদয় আলোকিত করে থাকা প্রদীপ।

শেষপর্যন্ত এই একবছর আগে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ইন্তেকাল করার পরই কেবল মেহরুন তার স্বামীকে পুরোপুরি নিজের মতো করে পেলো। তার সবকটি ননদের বিয়ে-শাদি হয়ে গিয়েছে; যে যার যার স্বামীর বাড়িতে সংসার করছে। দেবররাও যে যার ভবিষ্যতের রাস্তায় দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিনে, এতো বছর পর এসে তার দীর্ঘ-লালিত স্বপ্নটা পূরণ হলো; নিজের একটা বাড়ি হলো। আর স্বপ্ন যখন পূর্ণ হলো, তখন তার মুখের চামড়া কুঁচকে এসেছে, হাতের শিরাগুলো ঠেলে উঁচিয়ে উঠেছে। চোখের নিচে পাতলা ছায়া জমেছে, ফেটে হা হয়ে গেছে দুই গোড়ালি। আঁটো ও অ-সমান করে কাটা নখের মধ্যে কালো-ময়লা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে; চুল পাতলা হয়ে গেছে। আর সে এসবের কিছুই খেয়াল করে উঠতে পারেনি। ইনায়েতও হয়ত নিজের অ্যাপেনডিক্স অপারেশান না হলে এসব খেয়াল করত না।

প্রাইভেট হাসপাতালের সামান্য বেতনের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে চলা ঐ নার্স মেয়েটার চোখে তখন হাজারো স্বপ্ন। মেয়েটা হাঁটত, নাকি বাতাসে ভাসতো—কেউ বলতেও পারবে না। তার চকচকে আভাময় ত্বক আর মধু-রঙা চোখ ঘূর্ণাবর্তের মতো যে কাউকে তার দিকে টেনে নিতো। ত্রিশের কোটা ধরে মেয়েটার বয়স এগিয়ে যাচ্ছিল। তাই নিজের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে, স্বপ্নগুলোকে সার্থক করতে সে যেকোনো কিছু করার জন্য প্রস্তুত ছিল; একেবারে যেকোনো কিছু! হাসপাতালের দিনগুলোতে ইনায়েত এই নার্সকে একবারের জন্যও ‘সিস্টার’ বলে ডাকেনি। প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সে তাকে তার নাম ধরেই ডেকেছে।

আর এরপরই ইনায়েত সেই গর্ভকে অপমান-অস্বীকার করে বসলো—যে গর্ভ তাকে এতোগুলো সন্তান উপহার দিয়েছে। সে মেহরুনের ঝুলে পড়া পেট নিয়ে খোঁটা দিতে শুরু করলো। তার ঝুলে পড়া স্তনযুগল নিয়ে খোঁচা দিতে লাগলো, যে স্তন তার সন্তানদের ক্ষুধা মিটিয়ে এসেছে। ইনায়েতের অশ্রাব্য সব কথা ও খোঁচায় তার আত্মাও একেবারে নগ্নতা অনুভব করলো। একদিন তো ইনায়েত বলেই বসলো—‘তুমি এখন আমার মায়ের মতো।’ আর এই একটা বাক্য দিয়ে সে তাকে জ্বলন্ত নরককুণ্ডে জীবন্ত ঠেলে দিয়েছে। এ কথার পর থেকে এই কয়েক মাস প্রতি গাল খাবার মুখে তোলাই মেহরুনের কাছে ‘পাপ’ বলে মনে হয়েছে। নিজ বাড়িতেই অচিন-অচেনা অনুভব করার যন্ত্রণা তাকে তাড়া করতে শুরু করলো; অপমানের আগুন তাকে মাটিতে মিশিয়ে ফেললো। বাধ্য হয়েই শেষপর্যন্ত সে পরিবারের সাহায্য কামনা করেছিল।

রাত গভীর হতে হতে মেহরুনের অন্তর্গত তোলপাড় আরো শক্ত ও কঠোর হয়ে ওঠে। এমন নিঃসঙ্গ, অসহায় সে আগে কখনো বোধ করেনি। কোনোরকম কোনো আকাঙ্ক্ষা-বাসনা তার মনে কাজ করে না। সে বিছানায় উঠে বসে। তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার এখন কেউ নেই। ঠাট্টা-কৌতুকে তাকে উত্ত্যক্ত করার, আলিঙ্গনে ভরে নেবার, চুমু দেবার এখন কেউ নেই। ওসমস্ত কাজ যে লোকটা করতো, সে এখন অন্য কারো।

জীবনের যেন কোনো শেষ সে দেখতে পায় না। পিছন থেকে আসা আচমকা জোর শব্দও তাকে প্রকম্পিত করে না। সে বুঝে যায়, ফ্রেমে বাঁধা ছবিটা পড়ে গিয়েছে; শত টুকরো হয়ে কাচ ইতি-উতি ছড়িয়ে পড়েছে; টুকরো টুকরো হয়ে গেছে ফ্রেমটা; ছবিটা বেরিয়ে মেঝের উপর পড়ে আছে। কিন্তু এক ধরনের উদ্বেগ তার ভেতরে শক্ত-পোক্তভাবে বাসা বেঁধে ফেলায়, কী পড়লো, না ভাঙলো—সেসব নিয়ে ভাবতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হয় না। বিছানা ছেড়ে সে আস্তে-ধীরে উঠে দাঁড়ায়; দীর্ঘক্ষণ ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর শোবার ঘর ছেড়ে বাইরে আসে। তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রশান্তিময় ঘুমের কোলে তলিয়ে আছে। 

এরপর ধীর পদক্ষেপে, প্রায় নিঃশব্দে সে যখন বসার ঘরে আসে, দেখতে পায়—সালমা পড়তে পড়তে টেবিলে হাত-মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে তার ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটার পাশে দাঁড়ায়, আর কাঁপতে শুরু করে। সে ভেবেছিল তার সকল অনুভূতিই এখন মৃত; কিন্তু সালমার দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে আবেগের উথালপাথাল ঢেউ তাকে আন্দোলিত করতে থাকে। শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে তার পড়ে যেতে ইচ্ছে হয়। মেয়েটাকে একটু ছোঁয়ার, আর ওর অন্তরকে—‘মা রে, তোকে যে এই বাচ্চাগুলোর মা হতেই হবে!’—এই কথাটুকু বলার দুর্মর-দুর্বার বাসনা সে অনেক কষ্টে সামলে সংযত করে নেয়।

মেহরুনের পা আস্তে আস্তে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। সামনের দরজা খুলে সে উঠানে এসে দাঁড়ায়। যে অল্প কয়টা গাছের সে যত্ন-আত্তি করতো, সেগুলো যেন সবাই কাঁদছে। যেন ওর নেয়া সিদ্ধান্তকে ওরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাচ্ছে। এরপর সে আবার ঘরে ঢুকে পড়ে; দরজা বন্ধ করে দিয়ে, রান্নাঘরে চলে যায়। সেখান থেকে কেরোসিনের পাত্র হাতে তুলে নিয়ে সে সারা বাড়ি ঘুরঘুর করতে থাকে। সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারে না যে, কোথায় দাঁড়িয়ে তার নিজের গায়ে কেরোসিন ঢালা উচিত। বসার ঘরে ফিরে যাবার আগে, ঘুমন্ত বাচ্চাদের দেখার জন্য সে আরেকবার থামে।

সে সালমার দিকে তাকায় না।

এরপর, সে দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে গিয়ে ম্যাচবাক্সটা তুলে নিয়ে ডানহাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে। তারপর বসার ঘর পেরিয়ে, নিঃশব্দে সামনের দরজার হুড়কো খুলে আবার সামনের উঠানে নেমে আসে। সেই অন্ধকারে তাকিয়ে, তার যে কেউ নেই, কেউ যে আর তাকে চায় না—এমনসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে সে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢালতে থাকে। তার নিয়ন্ত্রণাতীত এক প্রবল শক্তি তাকে পেয়ে বসেছে। সে চারধারে তাকায়; কোনো শব্দ তার কানে পৌঁছায় না। কোনো স্পর্শ সে অনুভব করে না, কোনোকিছুর কোনো স্মৃতি থাকে না; কোনো সম্পর্কই তাকে ভেদ করতে পারে না। স্বাভাবিক চেতনা ও জ্ঞান-বোধের বাইরে চলে গিয়েছে সে।

কিন্তু ঘরের মধ্যেই তখন সবকিছু ঘটে চলছিল—বাচ্চা বোনের ক্ষুধার্ত চিৎকারে সালমা চমকে জেগে ওঠে; দৌড়ে বোনকে কোলে নিয়ে সে ‘আম্মি, আম্মি’ করে অন্য ভাইবোনদের ঘরে খুঁজতে ঢুকে পড়ে। এরপর বাড়ির অন্যসব ঘর খুঁজে, শেষে সামনের দরজা খোলা দেখতে পেয়ে দৌড়ে সামনের উঠানে নেমে আসে। সেই দুর্বোধ্য অন্ধকারের মধ্যেও সে তার মায়ের আকৃতি বুঝে নেয়; কেরোসিনের উৎক গন্ধ তার নাকে আঁছড়ে পড়ে।

কোনো ভাবনা ছাড়াই সালমা ছুটে সামনে এগিয়ে যায়; শিশু বোনকে আগলে ধরে তার আম্মিকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে। ম্যাচবাক্স মুঠিতে চেপে ওর মা তাকে জড়িয়ে ধরা কিশোরীর দিকে আবেগহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে; যেন সে অন্য কাউকে আশা করছিল। সালমা তড়িঘড়ি বোনকে মাটির উপর শুইয়ে দিয়ে চিৎকার-কান্নায় ভেঙে পড়ে, আর মায়ের পা-দুটি জড়িয়ে ধরে জড়ানো কণ্ঠে বলে—‘আম্মি! আম্মি! আমাদের এভাবে ফেলে চলে যেয়ো না!’

সালমার ফোঁপানো কান্নার সাথে মাটিতে শুইয়ে রাখা শিশু মেয়েটির চিৎকার-কান্না মিলেমিশে যায়। মেহরুন ওদের দিকে তাকায় আর তাকে আঁকড়ে-জাপটে ধরা অদ্ভুত ও ভয়ানক শক্তিটার সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ম্যাচবাক্সটা মুঠো থেকে খসে পড়ে। সালমা তখনো মায়ের পা জড়িয়ে ধরে থাকে। ‘আম্মি,’ সালমা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তুমি একজন মানুষকে হারিয়েছো বলে আমাদেরকে ঐ মহিলার করুণার উপর ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছো? আব্বার জন্য তুমি মরতে তৈরি, কিন্তু আমাদের জন্য তোমার বেঁচে থাকা কি সম্ভব নয়? আমাদের সবাইকে তুমি কীভাবে এতিম বানিয়ে রেখে যেতে পারো? আম্মি? আমরা যে তোমাকে চাই!’

মেয়ের কথার চেয়ে মেয়ের স্পর্শ মেহরুনের উপর বেশি প্রভাব ফেলে। সে কাঁদতে থাকা বাচ্চাকে দুহাতে তুলে নিয়ে, সালমাকে তীব্র আলিঙ্গনে বুকের সাথে জাপটে ধরে। কেউ একজন তাকে স্পর্শ করছে, আশ্বস্ত করছে, বন্ধুর মতো তাকে বুঝছে—এই অনুভূতিতে তার দুচোখ ভারী হয়ে ওঠে। সে শুধু এতটুকু বলতে পারে—‘মাফ করে দিস আমার মেয়েটা।’

রাতের অন্ধকার তখন গলে গলে খানিকটা কোমল-তরল হয়ে এসেছে।





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত