Homeজাতীয়যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান


পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছিল সেটাই সত্যি হলো। পাকিস্তানে সরাসরি বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ভারত। এতে অন্তত ২৬ পাকিস্তানি নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালিয়েছে ভারতের মাটিতে। এতে অন্তত ১৫ ভারতীয় নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। দেশটির একাধিক সেনা চৌকিও ধ্বংস হয়। এছাড়া ভারতের অন্তত ৫টি জঙ্গি বিমান ও একটি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
মঙ্গলবার মধ্যরাতের এই হামলা-পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে প্রায় দুই দশকের মধ্যে ভয়াবহ সংঘাতে জড়াল এই দুই প্রতিবেশী। পাকিস্তানে ভারতের হামলায় নিহতদের মধ্যে জঙ্গি সংগঠন জয়শ-ই-মোহাম্মদের সাবেক প্রধান মাসুদ আজহারের ১০ আত্মীয়ও আছেন। এছাড়া পাকিস্তানের মসজিদসহ অন্তত ১০টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। তবে নয়া দিল্লির দাবি ২৬ নয়, তাদের হামলায় ৭০ পাক নাগরিক নিহত হয়েছেন। 
খবর বিবিসি, আলজাজিরা ও সিএনএন অনলাইনের। 
পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ চিরবৈরী এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধ এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ। উভয় দেশকেই সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে চীন। আর আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার অনুরোধ করেছে জাপান।
ভারত পাকিস্তানে তাদের অভিযানের নাম দিয়েছে ‘সিঁদুর’। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত একটা পাঁচ মিনিটে শুরু হয়ে অভিযান চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। হামলায় অন্তত ৮০টি জঙ্গিবিমান ও ড্রোন ব্যবহার করে ভারত। ২৫ মিনিট স্থায়ী এই অভিযানে পাকিস্তানের অন্তত ২৪ টার্গেটে হামলা চালানো হয়। 
ভারতের এই হামলার পর কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই হামলার প্রতিশোধ নিতে দেশটির সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছেন। পাকিস্তান সাফ বলেছে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। দেশটি হুঁশিয়ার করে বলেছে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ও বেসামরিক লোকজনকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে সময়মতো ভারতের বিরুদ্ধে কড়া জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে ইসলামাবাদ। 
বুধবার পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, নিজেদের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।  
ওই বৈঠকের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ দেশটির পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, তার দেশের সেনাবাহিনী ভারতের ৫টি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে দুটি কাশ্মীরে এবং একটি ভারতের বাথিন্ডায় ভূপাতিত করা হয়। 
পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ বলেন, ভারতের হামলার হিসাব দ্রুতই মোহাম্মদ আসিফ বলেন, আমাদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখবে ভারত। তিনি বলেন, পাকিস্তানের হামলা হবে সুনির্দিষ্ট ও সংক্ষিপ্ত। এই সময়ের মধ্যে ভারত আমাদের শক্তিমত্তা টের পারবে।  
এদিকে হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। পাকিস্তানে বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ষোল শতাংশ এবং ভারতের প্রায় তিন শতাংশ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে বলে ফ্লাইট ট্র্যাকিং সার্ভিস ফ্লাইটরাডার২৪ জানিয়েছে। তাদের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানে মোট ১৩৫টি ফ্লাইট আর ভারতে ৪১৭টি নির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ ভারতীয় পর্যটক নিহত হন। এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বাকে দায়ী করে আসছে ভারত। এরপর থেকেই দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সীমান্তে গুলিবিনিময় শুরু হয়। 
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত বিশ্ববাসী বহন করতে পারবে না। অন্যদিকে সংঘাত দ্রুতই থেমে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুদেশের মধ্যে শান্তি প্রচেষ্টায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি নয়াদিল্লি সফর করছেন। দুই দিন আগে তিনি ইসলামাবাদ সফর করেন। 
এই হামলা নিয়ে ভারতের সেনাবাহিনী একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, মঙ্গলবার মধ্য রাতে তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের একাধিক আলাদা স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা করেছে, যাকে তারা ‘সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামো বলে বর্ণনা করেছে। তাদের দাবি, এসব হামলা চালানো হয়েছে ‘সুনির্দিষ্ট, পরিমিত এবং উস্কানিবিহীন’ পদ্ধতিতে। ভারত এও বলছে, তারা কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনায় হামলা করেনি। 
পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়ালে ভারতও প্রতিক্রিয়া’ জানাতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। বুধবার বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ বার্তা দেন। ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, জাপান, ফ্রান্স ও রুশ নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের ব্রিফ করেন দোভাল। 
তবে ইসলামাবাদ জানিয়েছে, ভারত পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ২৪ স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এটিকে তারা ‘কাপুরুষোচিত হামলা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা এও বলেছে, গত মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো যোগসূত্র নেই। তাই  এই হামলার কঠিন জবাব দেওয়া হবে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক ও মসজিদকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করে ভারত। 
‘অপারেশন সিঁদুর প্রসঙ্গে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তানের মসজিদগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। এটি নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে বেড়ে ওঠা সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন। যেখানে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের টার্গেট করা হচ্ছে। পাক সেনাবাহিনীর এই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘এটি মনে রাখা জরুরি যে যেসব স্থানে হামলা হয়েছে, সেগুলোতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম আগের দিন গিয়েছিল। তারা দেখেছে, ওই স্থানগুলোতে বেসামরিক মানুষ অবস্থান করছিল। 
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভারত-পাকিস্তানের এই সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে  উদ্বেগ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ইসরাইল ভারতের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। ভারতে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত রিউভেন আজার এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের জানা উচিত, নিরীহদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করে লুকিয়ে থাকার কোনও স্থান নেই। পাকিস্তানের প্রতি সংহতি জানিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে তুরস্ক। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারকে টেলিফোনে ইসলামাবাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।
পাক-ভারত সংঘর্ষের ইতিহাস ॥ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। তার বেশিরভাগই ঘটেছে কাশ্মীর ঘিরে। ভারতবর্ষ ভাগের কয়েক মাস পরেই প্রথম সংঘর্ষের সূচনা হয়। পরে ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কাশ্মীরকে দুইভাগে বিভক্ত করে একটি যুদ্ধবিরতি হলেও উভয় পক্ষই পুরো কাশ্মীরের অধিকার দাবি করতে থাকে। 
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি বাহিনী সীমানা অতিক্রম করে ভারত শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশ করার পর তাদের মধ্যে স্থলে ও আকাশে পুরাদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে আবার দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। সেই সময় ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থীদের সহায়তা করে, যার ফলে পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্ম হয়। 
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানি সেনারা আবার ভারত শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পর এটিই প্রথম দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের সংঘর্ষের ঘটনা, যা সারাবিশ্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। 
২০১৬ সালে উরি হামলার পর পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা বোমা হামলার ঘটনার জেরে বালাকোটের কাছে বিমান হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তানও পাল্টা বিমান হামলা করে তার জবাব দেয়। কারগিল যুদ্ধের পর সেবারই দুই দেশের মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল।-বিবিসি অবলম্বনে





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত