দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের সরকারি টিকার (র্যাবিক্স-ভিসি) সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের শিকার ব্যক্তিদের নিজের টাকায় টিকা কিনতে হচ্ছে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের কাছে মজুত টিকা চলতি মে মাসেই শেষ হচ্ছে। বেশির ভাগ জেলা-উপজেলায় স্বল্পসংখ্যক টিকা রাখা হয়েছে, যা জরুরি প্রয়োজনে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, স্বাস্থ্যের কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) না থাকায় জলাতঙ্ক টিকার এই সংকট হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি কর্মসূচির কার্যক্রম চলে পাঁচ বছর মেয়াদি ওপির মাধ্যমে। গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি)’। জুলাইয়ে পাঁচ বছরের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি বা ওপি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন সরকার তা অনুমোদন দেয়নি। ওপি থেকে বের হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে ২০১১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি চালু করে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখা এই কর্মসূচি পরিচালনা করছে। সিডিসি বলছে, জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু শতভাগ হওয়ায় ২০১১ সালে বিনা মূল্যে সারা দেশে টিকা দেওয়া শুরু করা হয়। সিডিসি সরাসরি টিকা কিনত। বর্তমানে ওপি না থাকায় সরকারের বিশেষ বরাদ্দে টিকা কিনছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। গত ফেব্রুয়ারিতে সিএমএসডি ১ লাখ ৪ হাজার টিকা কেনে। বর্তমানে কেন্দ্রীয়ভাবে টিকা রয়েছে প্রায় ২ হাজার। এর বাইরে জেলা ও উপজেলায় জরুরি প্রয়োগের জন্য কিছু টিকা রয়েছে। চলতি মাসেই এই টিকার মজুত শেষ হবে। প্রাণীর আক্রমণে রক্তাক্ত আহতদের টিকা ছাড়াও অতিরিক্ত হিসেবে র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) দেওয়া হয়। সরকার এখন আরআইজি কিনছে না। এক ডোজ টিকার দাম স্থানীয় বাজারে ৫০০ টাকা। আরআইজির দাম ১ হাজার টাকা।
সরকারের হিসাবে, গত বছর কুকুরসহ প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রে এসেছিলেন সোয়া ৫ লাখ মানুষ। গত বছর জলাতঙ্কের কারণে ৫৬ জনের মৃত্যু হয়। প্রাণীর আক্রমণের শিকার একজন ব্যক্তিকে তিন থেকে চার ডোজ র্যাবিস টিকা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে ৫ লাখ, ২০২২ সালে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ ন্যূনতম তিন ডোজ করে টিকা নিয়েছেন। সারা দেশে উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ চার শতাধিক টিকাকেন্দ্রে প্রাণীর আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের টিকা দেওয়া হয়।
অন্তত পাঁচটি জেলা ও উপজেলায় খোঁজ নিয়ে র্যাবিক্স টিকার সংকটের তথ্য জানা গেছে। রোগীরা স্থানীয় বাজার থেকে টিকা কিনে দিচ্ছেন। আরআইজিও তাঁদের কিনতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম জানান, সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে টিকা আছে, তা জরুরি মুহূর্তে দেওয়ার জন্য। একই কথা বলেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কিশলয় সাহা। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘পাঁচ মাস ধরে টিকার সংকট। জরুরি মুহূর্তে প্রয়োগের জন্য আমরা ৫০ ভায়াল এনে রেখেছি। কেউ গভীর রাতে আক্রান্ত হয়ে এলে তার জন্য টিকা সংগ্রহ করা কঠিন। অথবা যেসব রোগীর ক্রয়ক্ষমতা নেই, তাদের দেওয়া হচ্ছে। অথবা প্রথমটি বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে, পরে নিজেরা সংগ্রহ করে নিচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, রাস্তাঘাটে কুকুরের সংখ্যা বেড়েছে। জলাতঙ্ক রোধে কুকুরকে টিকা দেওয়ার কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ। আবার আক্রান্ত মানুষকে দেওয়ার টিকারও সংকট দেখা দিয়েছে। কর্মসূচি না থাকায় দীর্ঘ দিনের অর্জন হুমকিতে পড়েছে। নীরবে রোগী বাড়ছে।
রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চলতি বছরের শুরু থেকে গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত কুকুর, বিড়াল, বেজি, বানর ও খ্যাঁকশিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছেন সাড়ে ৪৪ হাজার মানুষ। আক্রমণে রক্তাক্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজার।
ওই হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ও তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আরিফুল বাসার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে আরআইজি সরবরাহ নেই কয়েক সপ্তাহ। যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা নিজেরা সংগ্রহ করেন। টিকার সরবরাহ পাচ্ছি। তবে অন্যান্য হাসপাতালে টিকা নেই বলে রোগী এখানে পাঠানো হয়। রাজধানী ছাড়াও সারা দেশ থেকে বহু রোগী আসেন।’
শুধু এই হাসপাতালেই গত বছর প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নেন ১ লাখ ২২ হাজার ২৬৩ জন। ২০২৩ সালে ৯৪ হাজার, ২০২২ সালে ৮৯ হাজার ৯২৮ জন চিকিৎসা নেন। এসব রোগীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই কুকুরের আক্রমণের শিকার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী বিড়ালের আক্রমণে শিকার। বেজি, বানর ও খ্যাঁকশিয়ালের আক্রমণের শিকার রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এশিয়া ও আফ্রিকাতে জলাতঙ্ক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এই রোগে মৃতদের ৪০ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের কম।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, জলাতঙ্কে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের জলাতঙ্ক-প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। রোগটির ৯৬ শতাংশের কারণ কুকুরের কামড়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের (সিডিসি) জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের উপব্যবস্থাপক ডা. এস এম গোলাম কায়সার আজকের পত্রিকাকে বলেন, জলাতঙ্কে ২০১০ সালের আগে বছরে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হতো। জলাতঙ্ক রোগীর মৃত্যু শতভাগ। সিডিসি কর্মসূচি নেওয়ায় সেই মৃত্যু কমে দুই অঙ্কে নেমে এসেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাতঙ্ক রোগে এক সপ্তাহ বা দেড় সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু হয়। ওপির কারণেই কালাজ্বর, গোদরোগ, জলাতঙ্কসহ এমন অনেক রোগ নির্মূল হয়েছে বা নির্মূলের পথে। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া ওপি বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সিডিসি) ডা. মো. হালিমুর রশিদ বলেন, ‘খুব হিসাব করে টিকা হাসপাতালগুলোকে দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আমাদের চাহিদা দিলে তা সিএমএসডিকে দেওয়া হয়, পরে তারা টিকা পাঠায়। আগে ওপির মাধ্যমে টিকা কেনা হতো। এখন সরকারের বিশেষ বরাদ্দে সিএমএসডি কিনেছে। তবে মজুত শেষের পথে। নতুন করে কেনার প্রক্রিয়া চলছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানান, স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি র্যাবিসের টিকা ডব্লিউএইচও-এর প্রি-কোয়ালিফাইড নয়। টিকা কিনতে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ডব্লিউএইচওর সনদ চাইলে তারা দিতে পারেনি। সরকার গত ১০ বছরের বেশি সময় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের টিকা কিনছে।
স্থানীয় উৎপাদিত টিকা ডব্লিউএইচওর মানদণ্ডে পরীক্ষিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও লাইন ডিরেক্টর (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমি ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলাম। তখন সারা দেশে জলাতঙ্ক টিকা প্রয়োগ সম্প্রসারণ করেছি। টিকাকে ডব্লিউএইচও প্রি-কোয়ালিফাইড হওয়ার বাধ্যবাধকতা করেছিলাম। আমি যত দিন ছিলাম তত দিন বিদেশি প্রি-কোয়ালিফাইড টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টিকার সংকট এমনটি বলা ঠিক হবে না। সরকার বিশেষ বরাদ্দে কিনছে। স্থানীয় কোম্পানির টিকা প্রি-কোয়ালিফাইড নয়, এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তারা তাদের টিকা পরীক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছে।’