বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারক চীন। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভেনেজুয়েলা সরাসরি কোনো দেশে তেল রপ্তানি করতে পারে না। কিন্তু ‘ব্র্যান্ড’ পরিবর্তন করে ঠিকই চীনে রপ্তানি করছে দেশটি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলার তেল ব্রাজিলের নামে চীনে যাচ্ছে। গত এক বছরে এই কৌশলে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের তেল রপ্তানি করেছে ভেনেজুয়েলা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে সাগরপথে এই তেল সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে একাধিক মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ী।
এই কৌশলের মাধ্যমে শুধু নিষেধাজ্ঞা এড়ানোই নয়, বাঁচানো হচ্ছে সময় ও খরচও। আগে যেখানে ভেনেজুয়েলা থেকে চীনে যাওয়ার পথে মালয়েশিয়ার উপকূল ঘুরে যেতে হতো, সেখানে এখন সোজা পথে চীন পৌঁছে যেতে পারছে তেলের ট্যাংকার, সময় কমছে অন্তত চার দিন।
২০১৯ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার জ্বালানি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো নির্বাচনে জালিয়াতি করে ক্ষমতায় টিকে আছেন এবং বিরোধীদের ওপর দমননীতি চালিয়ে যেতে তেল বিক্রির অর্থ ব্যবহার করছেন। এই নিষেধাজ্ঞাকে অর্থনৈতিক যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছে মাদুরোর সরকার।
এরপর থেকেই ব্যবসায়ীরা উৎস গোপন করতে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে পণ্য স্থানান্তরের মতো কৌশল গ্রহণ করছেন। এখন আরও একধাপ এগিয়ে তাঁরা ব্যবহার করছেন ‘স্পুফিং’ নামে বিশেষ কৌশল—যেখানে ট্যাংকারের স্যাটেলাইট সিগন্যাল জালিয়াতি করে দেখানো হয় জাহাজটি ভেনেজুয়েলা থেকে নয়, বরং ব্রাজিল থেকে রওনা হয়েছে।
বাণিজ্যিক জাহাজের তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা ট্যাংকার ট্র্যাকারস ডট কম জানায়, দৈনিক ভেনেজুয়েলার প্রায় ৬৭ হাজার ব্যারেল তেল ব্রাজিলের নামে চীনে প্রবেশ করে। ওয়েবসাইটটির তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত চীনে প্রবেশ করা প্রায় ২৭ লাখ টন মিশ্র বিটুমিন তেলের সবটাই ভেনেজুয়েলার। তবে, কাগজে কলমে এগুলো ব্রাজিলের বলে দেখানো হয়েছে। গত আট মাসে চীনে রপ্তানি হওয়া এই ২৭ লাখ টন তেলের বাজারদাম প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
ব্রাজিলের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাস স্পষ্ট করে জানিয়েছে, চীনে কোনো বিটুমিন পাঠায় না তারা। দেশটির কাস্টমস তথ্যেও চীনে বিটুমিন রপ্তানির কোনো প্রমাণ নেই। মিশ্র বিটুমিন বা বিটুমিন ব্লেন্ড হচ্ছে আলকাতরা জাতীয় অবশেষ, যা সাধারণত অ্যাসফল্ট তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। অথচ ব্রাজিল সাধারণত রপ্তানি করে মাঝারি ঘনত্বের ‘মিডিয়াম-সুইট’ ধরনের অপরিশোধিত তেল, যা মূলত উপকূলীয় অঞ্চলের প্রি-সল্ট তেলক্ষেত্র থেকে আহরিত।
ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাসের প্রধান নির্বাহী ম্যাগদা চ্যামব্রিয়ার্ড সম্প্রতি হিউস্টনে এক সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চীনে যা রপ্তানি করি, তা মূলত প্রি-সল্ট উৎসের অপরিশোধিত তেল, বিটুমিন নয়।’
রয়টার্সের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, ভরটেক্সা অ্যানালিটিকস নামের একটি ট্যাংকার ট্র্যাকার এবং ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পিডিভিএসএর অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, চীনে ব্রাজিলীয় বিটুমিন নামে প্রবেশ করা অনেক কার্গোতে আসলে থাকে ভেনেজুয়েলার ‘মেরেই’ নামের ভারী অপরিশোধিত তেল। সাধারণত চীনের বেসরকারি পরিশোধনাগারগুলো পিডিভিএসএর কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কিনে থাকে।
চীনা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই মেরেই তেলকে ‘বিটুমিন ব্লেন্ড’ নামে চিহ্নিত করা হয়। কারণ এর মাধ্যমে পরিশোধনাগারগুলোকে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে সরকার নির্ধারিত কোটা মেনে চলার প্রয়োজন হচ্ছে না।
ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেলকে ব্রাজিলীয় তেল হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবসায়ীরা কৌশলে জাল উৎস সনদ (সার্টিফিকেট অব অরিজিন) ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন তিনজন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী। এই পরিবর্তনের জন্য ট্যাংকারগুলোকে ব্রাজিলের কোনো বন্দরে যেতে হয় না, এমনকি শিপ-টু-শিপ লোডিংও করা হয় না।
ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি পিডিভিএসএর নথি ও ট্যাংকার ট্র্যাকার্স ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, হাংঝোউ এনার্জি নামের একটি মধ্যস্থতাকারী কোম্পানির নামে ভেনেজুয়েলার তেল বহনকারী বেশ কয়েকটি ট্যাংকার ‘স্পুফিং’ করেছে—অর্থাৎ স্যাটেলাইটে তাদের অবস্থান ব্রাজিল দেখানো হয়েছে, যদিও বাস্তবে তারা ভেনেজুয়েলাতেই জাহাজীকরণ করেছে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী ট্যাংকার কারিনা, ক্যাটেলিন ছদ্মনামে ভেনেজুয়েলার মেরেই ১৬ ক্রুডের ১৮ লাখ ব্যারেল তেল হাংঝোউ এনার্জির জন্য লোড করে। স্পুফিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হয় যে, ট্যাংকারটি ব্রাজিল থেকে যাত্রা করেছে। পরে এপ্রিলের শুরুতে চীনের ইয়াংপু বন্দরে খালাস করা হয়।
এ বিষয়ে চীনের কাস্টমস এজেন্সি পিডিভিএসএ, ভেনেজুয়েলার জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও ব্রাজিল সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে রয়টার্স। কিন্তু তারা কেউই সাড়া দেয়নি।
ভেনেজুয়েলার তেলকে ব্রাজিলের নামে চীনে পাঠানোর পেছনে শুধু দূরত্বই কমায়নি, অর্থায়নের সুবিধা পাওয়াটাও একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিজ্ঞ তেল ব্যবসায়ী বলেন, ‘জাহাজভাড়া খুব বেশি কমানো না গেলেও, এভাবে ব্রাজিলীয় পরিচয় দিলে ব্যাংক থেকে অর্থ পাওয়া সহজ হয়, যা দীর্ঘ দুই মাসের যাত্রাপথে ব্যবসায়ীদের অর্থসংস্থান করে।’
পিডিভিএসএর নথি ও রয়টার্সের শিপিং ডেটা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীনে দৈনিক ৩ দশমিক ৫১ লাখ ব্যারেল ভেনেজুয়েলার তেল ও হেভি ফুয়েল রপ্তানি হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ লাখ ব্যারেলে। এসব আমদানির অধিকাংশই এখনো কাগজে মালয়েশীয় তেল বা মিশ্র বিটুমিন হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়। ভেনেজুয়েলা থেকে প্রকৃত আমদানির ১০ শতাংশেরও কম চীনা কাস্টমস নথিতে উল্লেখ করা হয়।
চীন এবং ভেনেজুয়েলা উভয়েই বারবার একতরফা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে আসছে। তাই দুই দেশ এখন হয়ে উঠেছে একে ওপরের সহায়ক।