পুলিশের সামনে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে—এই দাবিতে সম্প্রতি একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছে। একই ক্যাপশনে ভিডিওটি বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে ছড়ানো হয়েছে। ভিডিওটিতে একজন অর্ধনগ্ন ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁকে লাঠিসোঁটা দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করছে কয়েকজন। তখন সেই ব্যক্তিকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একজন নারীকে চেষ্টা করতে দেখা যায়। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ। এর মধ্যে পুলিশের পোশাক পরা দুই ব্যক্তিকে দেখা গেছে। তাঁদের একজন ফোনে কথা বলছিলেন এবং অপরজন উৎসুক ব্যক্তিদের সরিয়ে দিচ্ছিলেন।
‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ১টা ২৪ মিনিটে পোস্ট করা ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে। এর ক্যাপশনে লেখা, ‘বর্তমান দেশের পরিস্থিতি পুলিশের সামনে কিভাবে একজন মানুষকে হত্যা করলো।’ (বানান অপরিবর্তিত)
আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভিডিওটি ২ লাখ ২৬ হাজার বার দেখা হয়েছে এবং ১ হাজার ৯০০টি রিঅ্যাকশন পড়েছে। এতে ১৭৮টি কমেন্ট পড়েছে এবং শেয়ার হয়েছে ২ হাজার ২০০।
মনিরুজ্জামান মনির, মো. পাবেল ইসলাম, Kunu Miah নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টও Haque GreenBangla.com নামে ফেসবুক পেজ থেকে প্রায় একই ক্যাপশনে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে।
ভিডিওটির কিছু কি-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ‘রাজনৈতিক কুকর্ম ও কুকীর্তি’ নামে একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে একই দৃশ্য দেখা যায়। এটি ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত। এর সঙ্গে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর মাটিতে পড়ে থাকা ব্যক্তি, তাকে আঘাতের দৃশ্য, এক নারী বাঁচানোর চেষ্টা, আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, পুলিশের পোশাকে থাকা ব্যক্তি ও আশপাশের ঘরবাড়ি ও গাছপালার একই দৃশ্যের মিল রয়েছে।

এই ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা, ‘লীগারদের জন্য করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে!’ (বানান অপরিবর্তিত)
একই টেলিগ্রাম চ্যানেলে ২০২৪ সালের ১৬ জানুয়ারিতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর দৃশ্যসহ অন্তত আরও তিনটি পোস্ট (১, ২, ৩) পাওয়া যায়।
এসব পোস্টের ক্যাপশন থেকে জানা যায়, সেই সময় ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার পাইথল ইউনিয়নের বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও গয়েশপুর বাজারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হারুনকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুবেল কুপিয়ে হত্যা করে। পরে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে রুবেলের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং তাকে পিটুনি দেয়।
‘রাজনৈতিক কুকর্ম ও কুকীর্তি’ নামে টেলিগ্রাম চ্যানেলে ভিডিও প্রকাশের তারিখ ও তথ্য গুগলে সার্চ করে আজকের পত্রিকায় ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সাড়ে ১২টার দিকে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার পাইথল ইউনিয়নের গয়েশপুর বাজারে হারুন অর রশিদ (৫৫) নামের এক ব্যক্তি নিজের দোকানের পাশে চা খাচ্ছিলেন। এ সময় রুবেল মিয়া (৩৮) নামের একজন রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাঁকে হত্যা করে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে এলাকাবাসী রুবেলের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং পিটুনি দেয়। এতে রুবেল মিয়া ও তাঁর মা বিউটি আক্তার আহত হন।
একই তথ্যে জাতীয় দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার, যুগান্তর, মানবজমিনসহ একাধিক সংবাদমাধ্যমে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। তবে এই ঘটনায় নিহত হারুন অর রশিদ পাইথল ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন বলে এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। তবে হত্যাকারীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
ভিডিওটি এই ঘটনারই কি না, তার সত্যতা জানার জন্য আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের পক্ষ থেকে আজকের পত্রিকার গফরগাঁও প্রতিনিধি রুবেল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওটি পাঠিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভিডিওটি ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার পাইথল ইউনিয়নের গয়েশপুর বাজারে হারুন অর রশিদ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত রুবেল মিয়াকে এলাকাবাসীর পিটুনির দৃশ্য। ভিডিওতে মারধরের সময় বাধা দেওয়া নারী রুবেল মিয়ার মা। আর এই ঘটনায় রুবেল মিয়া মারা যাননি।’
বিষয়টি অধিকতর নিশ্চিত করতে গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খায়রুল বাশারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওটি পাঠিয়ে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি পুরোনো ঘটনা। যাকে মারা হচ্ছে, সে হারুন অর রশিদ নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এই ঘটনায় ৪ থেকে ৫ হাজার স্থানীয় উপস্থিত ছিল। স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে হত্যাকারীর বাড়িঘরে আগুন দেয় ও গণপিটুনি দেয়। মানুষ বেশি হওয়ায় আমরা মাত্র কয়েকজন পুলিশ সামাল দিতে পারিনি। ফোনকলের মাধ্যমে একাধিক পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে আমরা ফাঁকা গুলি করে তাদের উদ্ধার করেছিলাম।’
সুতরাং, পুলিশের সামনে একজনকে পিটিয়ে হত্যার দাবিতে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ভিডিওটি পুরোনো। তা ছাড়া ভিডিওতে মারধরের শিকার ব্যক্তি মারা যাননি, বেঁচে আছেন।