Homeদেশের গণমাধ্যমেপ্রেম-পরিবার-প্রজন্ম সবই জলের সাহচর্যে

প্রেম-পরিবার-প্রজন্ম সবই জলের সাহচর্যে

[ad_1]

পরিবার ও প্রিয়জন নিয়ে ধনীরা সংসার সাজান উঁচু ইমারতে। মধ্যবিত্তের পরিবারগুলো থাকে কাঠ-টিনের ঘরে। কারো কারো সংসার চলে খড়ের চালার নিচে। কেউবা থাকেন মাটির স্পর্শে, কাঠ বাঁশের ঘরে। আবার ভাগ্যদোষে কোনো কোনো পরিবার বসবাস করে পানির উপরে, ভাসমান নৌকায়। প্রতিটি নৌকায় নারী-পুরুষ-শিশু-সম্পূর্ণ পরিবার। নদীই তাদের জীবিকা, নদীই সংসার।

ভাসমান নৌকায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর নাম ‘মান্তা’। নদীতে মাছ ধরাই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। মাছ ধরে তা বিক্রি করেন, নদীর উপকূলের কোনো ঘাটে-বাজরে। সেই স্বল্প রোজগারেই নৌকার ছাউনিতে তাদের চুলা জ্বলে। খাওয়া-ঘুম-মাছ ধরা, সবই একটি নৌকার মধ্যে।

এই সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট বাসস্থান থাকে না। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারের খোঁজ নেই তাদের জীবনে। দেশের নাগরিক হয়েও মৌলিক অধিকারহীন যাযাবরের মতোই তাদের জীবন। প্রয়োজন হলে তীরে নৌকা ভেড়ে, আবার প্রয়োজনে ভেসে চলে। এমনই জীবনব্যবস্থা মান্তাদের। মান্তা পরিবারগুলো এভাবেই জীবন কাটায় যুগের পর যুগ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এলে নদীর কোঠরেই তাদের জন্ম-মৃত্যু। এ যেন প্রতিনিয়ত ঠিকানাবিহীন গন্তব্যে ভেসে চলা।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, উলানীয়া, লাহারহাট ও মিরগঞ্জ, হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর; ভোলার তুলাতলী মেঘনা পাড়, ইলিশা লঞ্চঘাট, তজুমদ্দিন উপজেলার সুলিজঘাট, মনপুরা; পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, চর জব্বার, গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি, চর মোন্তাজসহ নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় মান্তা সম্প্রদায়ের দেখা মিলবে। এরা দল বা বহর নিয়ে থাকে। দিনের বেলায় যে যার মতো মাছ ধরে বেড়ায়। রাতে আবার নৌকার সঙ্গে নৌকা বাঁধে। নৌকায় ভাসমান এই পরিবারগুলো একে অপরের সঙ্গী, প্রতিবেশী আর সুখ-দুঃখের সাথি।

মনে হতে পারে, এরা বুঝি জিপসি বা বেদে। কিন্তু তা নয়। মূলত মান্তা সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে নদী ভাঙানের ফলে। ভাঙনে জমিজমা হারিয়ে এসব পরিবারের পূর্বপুরুষরা ঘর বেধেছিলেন নৌকায়। এরপর থেকে অনেকেই ভিটে গড়ার জন্য নানা চরে নৌকা ভিড়িয়েছেন। কেউ কেউ তা পেরেছেন, আবার কারোবা এমন নৌকা জীবনের সমাপ্তি হয়নি। যারা নৌকাতেই রয়ে গেছেন, তারা নৌকায়ই সংসার গুছিয়েছেন, বংশ বিস্তার করেছেন। এভাবেই নদীর বুকে ভাসমান এই পরিবারগুলো নিজেরাই তৈরি করেছে নতুন সমাজ।

নদী-নৌকায় বাস করা সেই মানুষগুলোর মধ্যেও প্রেম-প্রণয়ের ইচ্ছে যাগে। দুটি আলাদা নৌকায় জন্ম নেওয়া দুটি ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়। এভাবেই নতুন আরও একটি ভাসমান নৌকার জন্ম হয়। এরপর সেই নৌকায়ও প্রজন্ম আসে। তখন এক অপরের প্রতি মমত্ববোধ, তাদের কষ্টগুলোকে ভুলিয়ে রাখে। পরিবেশ ওদের শিখিয়ে দেয়, ‘পরিবার-প্রজন্ম ঘিরে এখানেই সুখ খুঁজতে হবে’।

নৌকায় বেড়ে ওঠা এসব পরিবারের একটি শিশু আরেক নৌকার শিশুটিকে বন্ধু করে নেয়। জন্ম থেকেই ওদের জীবন কাটে নদীর জলে। শিশু শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারের খোঁজ মেলে না তাদের জীবনে। অশিক্ষা কুশিক্ষার মাঝে বেড়ে ওঠা শিশুগুলোর শিক্ষা বলতে শুধু বৈঠা চালানো আর জাল টেনে মাছ ধরা। শিশুরা অল্প বয়সেই শিখে যায়, মাছ ধরার নানা কৌশল।

মান্তা নারীদের জীবনও কাটে আবদ্ধ নিয়মে। যুগের পর যুগ তারা বাস করেছেন জলঘেরা জীবনে। তাদের সকাল-দুপুর-রাত কাটে নৌকায়। রান্না-খাওয়া, সন্তান লালনপালন সব কিছুই নৌকার মধ্যে। সঙ্গী বা সঙ্গ বলতে পাশে ভাসমান নৌকাটির আরেক নারী। নৌকার গৃহিণীরা একে অন্যের খবর নেন, কার নৌকায় কেমন মাছ পড়েছে, কোন নৌকায় কি মাছ রান্না হয়েছে। এটুকুই নৌকার নারীদের সামাজিক যোগাযোগ।

নৌকায় পুরুষটি পরিবারের খোরাক যোগাতেই দিনভর ব্যস্ত থাকেন। হাতে বৈঠা কিংবা জাল নিয়েই দিন কাটে তার। ক্লান্ত দেহে যখন ঘুমের দাপট, তখনো তার মাথায় থাকে নানা চিন্তা। তিনি স্বপ্ন দেখেন, কোনো একটা চরে কোনো একদিন ঘর তুলবেন! তিনি ভাবেন, কোনোদিন হয়তো এমন ভাসমান জীবনের অবসান হবে। এমন চিন্তা-স্বপ্ন নিয়েই প্রতিরাতে ঘুমান তিনি। একটি ঘর তোলার আশায়, আজ এক চরে তো কাল অন্য চরে নৌকা ভেড়ান। কিন্তু শেষমেশ সে আশায় নিরাশার ছায়াই পড়ে বেশি। একই রকম প্রতিদিন, এভাবেই কাটে যুগের পর যুগ।

বেশিরভাগ মান্তারা মেনে নিয়েছেন, পোড়া মানুষ এভাবেই থাকবে দরিয়ায়। ঢেউয়ে ঢেউয়ে লগি চালালে জালের গা জড়িয়ে উঠে আসবে স্বপ্ন। মাছ-ভাত, ছেলে-বউ-সংসার নিয়ে এক জীবন এভাবেই চালাতে হবে।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকার লঞ্চঘাটে দেখা হয় মান্তা ফরিদউদ্দিনের সঙ্গে। বলছিলেন, ‘বাবার নৌকায় থাকাকালে দেখে দেখে শিখেছি, কীভাবে পরিবার আগলে রাখতে হয়। তিনি যেভাবে আমাদের আগলে রেখেছেন, এখন আমিও আমার ছেলে-মেয়েকে আগলে রাখি। মান্তারা এমন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। সমাজের মানুষ আমাদের ভাসমান হিসেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, কিন্তু আমরা তো পরিস্থিতির শিকার।

চরমোন্তাজ মান্তা বহরের রিন্জু সরকার বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে নৌকায় বড় হয়েছি। আমার বাচ্চাদের জন্মও নৌকায়। আমাদের বাচ্চাগুলোর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, থাকা, খাওয়ার কোনো নিয়ম নেই। ওদের জীবনও আমাদের মতোই হচ্ছে। কিন্তু আমরা নিরুপায়, কিছুই করার নাই।’

তবে এমন পরিবারের জীবনব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ভূমিহীন এই ধরনের জনগোষ্ঠীকে সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত করতে হবে। তাদেরকে সমাজে স্থান দিতে হবে। মানুষ হিসেবে অধিকার দিয়ে এমন জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

কেএসকে/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

[ad_2]

Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত