Homeলাইফস্টাইলশারীরিক নির্যাতনের মতোই দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষত তৈরি করে সাইবার বুলিং: গবেষণা

শারীরিক নির্যাতনের মতোই দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষত তৈরি করে সাইবার বুলিং: গবেষণা


এক সকালে ঘুম ভেঙে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন ফেসবুক থেকে অনেকগুলো নোটিফিকেশন। অবাক হওয়ার বিষয়। তারপর চেক করে দেখলেন, আপনার এমন একটা ছবি বা ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করছে এবং সেই ছবি বা ভিডিও আপনার অনুমতি ছাড়াই একজন ধারণ করে আপলোড করে দিয়েছে। মানুষ কমেন্টে, মিম বানিয়ে, নিজেদের আইডিতে শেয়ার করে, আপনাকে ট্যাগ দিয়ে বেশ মজা করছে। বিষয়টি কেমন লাগবে?

এই ভয়াবহ বিষয়টি একধরনের সাইবার বুলিং। আর গবেষণা বলছে, এই সাইবার বুলিংয়ের কারণে যে মানসিক ক্ষত হয়, তার সময়ের দৈর্ঘ্য কোনো শারীরিক নির্যাতনের যন্ত্রণার মতোই।

বিএমসি পাবলিক হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণা করেছেন ফ্লোরিডা আটলান্টিক বিশ্ববিদ্যালয় (এফএইউ) ও উইসকনসিন-ইউ ক্লেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। এই গবেষণায় তাঁরা ২৬০০ জনেরও বেশি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়েছেন এবং এই জরিপের ফলাফল বেশ উদ্বেগজনক।

গবেষণায় উঠে এসেছে, সাইবার বুলিং বিষয়টি শুধু ক্ষণিকের দুষ্টুমি নয়, বরং এটি এ রকম বিরূপ শৈশব অভিজ্ঞতার মতো যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি। এটি ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে ধারণা এবং পৃথিবীতে নিজের অবস্থানকে বিকৃত করে। নীরব আক্রমণের মতো আঘাত হানে সাইবার বুলিং।

সাইবার বুলিংয়ের অনেক ধরন দেখিয়েছেন গবেষকেরা। অনেকের ওপর বাজে শব্দের প্রয়োগে হয়রানি করা হয় বা মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করা হয়, তা নয়। অনেক সময় সামাজিক প্ল্যাটফর্মে কোনো আলাপের মাঝে তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নীরবতা তৈরি করাও একধরনের সাইবার বুলিং।

গবেষকেরা বলছেন, ধরুন আপনি একটা গ্রুপ চ্যাটে আছেন। সেখানে অনেকক্ষণ ধরে কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। আপনি প্রবেশ করতেই কথোপকথন থেমে গেল। আপনিই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে সেখানে অঘোষিতভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আলাপ-আলোচনা পড়ে দেখলেন সেখানে কোথাও আপনি নেই, আপনার অস্তিত্ব নেই। এই যে কাউকে একা করে দেওয়া, এটি একধরনের সাইবার বুলিং।

এই গবেষণার প্রধান লেখক ফ্লোরিডা আটলান্টিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও অপরাধ বিচার বিভাগের অধ্যাপক ড. সামির হিন্দুজা বলেন, সাইবার বুলিং সব সময় উচ্চ স্বরে বা স্পষ্টভাবে ঘটে না। কখনো কখনো এটি অবহেলার আকারে আসে। আপনি লগ ইন করলেন, দেখলেন সবাই আড্ডা দিচ্ছে, শুধু আপনি ছাড়া। আবার এমনও হতে পারে, এমন আলাপ চলছে যেখানে আপনাকে হেয় করা হচ্ছে বা আপনাকে বাদ রেখেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

গবেষণাটিতে আরও দেখা গেছে, গত এক মাসে ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্তত একধরনের অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নয়জনই–তা-ও আবার এক মাসে।

এর মধ্যে রয়েছে—কোনো কথার মাঝে, কোনো মন্তব্য বা চ্যাটবক্সের আলাপের মাঝে ছোট ছোট খোঁচা, গুজব ও কটূক্তি। কোনো অবমাননাকর মন্তব্য, মিথ্যা অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া—এসব জমতে থাকে মনের ভেতরে এবং মানসিকভাবে গভীর প্রভাব ফেলে।

ড. সামির হিন্দুজা বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় স্পষ্টভাবে দেখা গেছে, যেকোনো ধরনের সাইবার বুলিং–তা গ্রুপ চ্যাট থেকে বাদ দেওয়া হোক বা সরাসরি হুমকি–যুবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানসিক আঘাতের কারণ হতে পারে।’

এ গবেষণায় ১৮ ধরনের সাইবার বুলিংয়ের কথা তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অর্ধেকের বেশি বলেছে, তারা অবমাননাকর মন্তব্যের শিকার হয়েছে। প্রায় সমসংখ্যক শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের গ্রুপ চ্যাট বা অনলাইন আলোচনায় ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত তথ্য অনুমতি ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেখেছে। আবার কেউ দেখেছে, কেউ একজন তার পরিচয় ব্যবহার করে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে এবং সুনাম নষ্ট করছে।

ড. হিন্দুজা জানান, যেকোনো ব্যক্তি–লিঙ্গ বা বয়স-নির্বিশেষে–সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। সাইবার বুলিংয়ের কারণে মেয়ে বা নারীরা সবচেয়ে তীব্র মানসিক আঘাত পেয়েছে। কিশোর-কিশোরীরাও একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লগ ইন করার ভয় তাদের ঘিরে ধরেছে।

গবেষকেরা বলছেন, এই সাইবার বুলিংয়ের প্রভাব শুধু তাৎক্ষণিক নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে এসব কারণে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন কেউ কেউ।

জরিপে দেখা যায়, এই মানসিক আঘাত কিছু মানুষের জীবনে একটি ছায়ার মতো লেগে থাকে। একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকে, যা কখনো শেষ হওয়ার নয়। কোনো নির্দিষ্ট নাম দেখলেই তাঁদের অতীতের স্মৃতি ফিরে আসে। ফোনের আলো জ্বললেই মনের গভীরে একধরনের আতঙ্ক জেগে ওঠে।

অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও শৈশবের বুলিংয়ের আঘাত বহু বছর ধরে বয়ে বেড়ান। এটি তাঁদের সম্পর্ক, কাজ ও দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। তাঁরা নিজেদের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সামান্য সমালোচনাতেও পিছিয়ে যান। তেমনি সাইবার বুলিংও একই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শুধু একটি সাময়িক সমস্যা নয়, এটি একটি ক্ষত, যা কখনো পুরোপুরি সেরে ওঠে না।

এই মানসিক আঘাত সম্পর্কে সচেতন প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন ড. হিন্দুজা। তিনি বলেছেন, ‘যুবকদের প্রকৃতপক্ষে সুরক্ষিত রাখতে হলে আমাদের মানসিক আঘাত সম্পর্কে সচেতন একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে, যা আবেগগত ও মানসিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়।’

শিক্ষার্থীদের এ ধরনের ঘটনার ভুক্তভোগী হওয়া থেকে রক্ষা করতে স্কুলগুলোকে পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এটি শুধু প্রকাশ্য হুমকি বন্ধ করার বিষয়ে নয়। এটি সেই নীরব, সূক্ষ্ম নিষ্ঠুরতাগুলো চিনতে শেখার ব্যাপার—বাদ দেওয়া, গোপন গুজব, বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্রুপ চ্যাট।

ড. সামির হিন্দুজা বলেন, স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের এমন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যা তাঁদের এসব হয়রানিতে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে এমন লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে। সেই শিশুকে খুঁজে বের করতে পারবে, যে আগে হাসত, এখন চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সাইবার বুলিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তুলে ধরে এই গবেষণায় অনলাইন বুলিংয়ের পর শিশুদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণার আহ্বান জানানো হয়েছে। সময়ের সঙ্গে কি তারা সুস্থ হয়ে ওঠে, নাকি আঘাত থেকে যায়? যাদের পরিবার বা বন্ধুদের সহায়তা নেই, তাদের কী অবস্থা? বিশেষ কার্যক্রম কি তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে?

হিন্দুজা বলেন, ‘আমাদের কাছে এখনো সব প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার–সাইবার বুলিংয়ের প্রভাবকে উপেক্ষা করা যাবে না। এটি শুধু শিশুদের আবেগপ্রবণতা নয়। এটি বাস্তব আঘাত, যা বুলিং শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এটি থেকে যায়। অনেকের জন্য এটি কখনো পুরোপুরি চলে যায় না, আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায়।’





Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত