Homeদেশের গণমাধ্যমেআজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই

আজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই

[ad_1]

প্রথম আলো :

আপনার এই রূপান্তর কী অক্সফোর্ডে অধ্যয়নের কারণে?

বদরুদ্দীন উমর: আমার মধ্যে দুটো চিন্তা বরাবরই ছিল। আমার বাবার রাজনীতি ও কমিউনিস্ট আদর্শের রাজনীতি। প্রথম দিকে বাবার রাজনীতির প্রভাব একটা ছিল। তবে সেটাকে আদর্শ বলে মনে করতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সেই প্রভাবটা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ছাড়ি, তখন এ প্রভাবটা আমার চলে গিয়েছিল। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা পর্যন্ত সময়টাকে অন্তর্বর্তীকাল বলা চলে। এই সময়টা বেশ দীর্ঘ। এর পর থেকে কমিউনিস্ট চিন্তাধারাতেই আমি চলেছি। আমার সাম্প্রদায়িকতা বইটি মার্ক্সবাদী ধারাতেই লেখা।

প্রথম আলো :

আপনি তো মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছিলেন?

বদরুদ্দীন উমর: আমি চাকরি ছেড়ে দেব, রাজনীতি করব, সেটা অনেক আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। পরে মোনায়েম খানের কর্মকাণ্ডে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। আমাকে তারা তাড়াতে কিংবা বরখাস্ত করতে পারত না, কিন্তু নানা রকম হয়রানি করছিল। চাকরি ছেড়ে গেলাম রাজনীতি করতে। মাওলানা ভাসানী বললেন, তুমি কৃষক সভার সম্পাদক হও। আমি বললাম, কি বলছেন আপনি? আমি বাংলাদেশের গ্রাম কিছুই জানি না। কৃষক কিছুই জানি না। কৃষক সভার সম্পাদক কী করে হব? তারপর উনি বললেন, তুমি ন্যাপের সম্পাদক হও। আমি তখন বললাম, আমি ন্যাপ করব না। আমি চাকরি ছেড়ে ন্যাপ করতে আসিনি। আমি কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছি। অন্য কোনো পার্টি করব না।

কমিউনিস্ট পার্টি তখন নানা ভাগে বিভক্ত। আমি সুখেন্দু দস্তিদার-আবদুল হকদের দলে যোগ দিলাম। অন্য যে পার্টিগুলো ছিল, সেগুলোর কোনোটাকেই কমিউনিস্ট পার্টি বলা যাবে না। নেতাদের কারও লেখাপড়া ছিল না। কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে আবদুল হকই মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি ‘পাঠ’ করেছেন, গভীরে যাননি। গণশক্তি পত্রিকায় তিনি যেসব লেখা লিখেছেন, সেগুলোও ছিল সুপারভিসিয়াল। শরতের মেঘের মতো দেখতে সুন্দর, ভেতরে প্রাণ নেই, জীবন নেই। সে কারণে একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে আমি পার্টি ছেড়ে দিলাম। এটা যেমন ঠিক, আবার এটাও ঠিক, এখন যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, আবার যদি সুযোগ হয় তুমি কোন পার্টিতে যোগ দেবে? আমি বলব, সুখেন্দু দস্তিদারের ওই পার্টিতেই যোগ দেব।

প্রথম আলো :

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট আন্দোলন তো সংকটে পড়ল?

বদরুদ্দীন উমর: এই সংকট তো তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও ইয়াহিয়া খানকে একই পাল্লায় মাপলেন। এটি কখনো হয় নাকি? যেখানে দেশের মানুষ লড়াই করছে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে, সেখানে তাঁরা বলে দিলেন ‘দুই কুকুরের লড়াই।’ এর চেয়ে সর্বনাশা কিছু হতে পারে না। তাঁদের উচিত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করা। এপ্রিলের শুরুতে একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে আমিও ছিলাম। সেখানে মাওলানা ভাসানীর একটি চিঠিও দেখানো হলো। ঠিক হলো কমিউনিস্টরাও একসঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু এপ্রিলের ১৩ বা ১৪ তারিখে আমি যশোরে ছিলাম। চৌ এন লাইয়ের বিবৃতি দেখানো হলো, যেখানে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলেছেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে সৈয়দ জাফর নামের এক কর্মী ছিলেন, তাড়াতাড়ি তাঁকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এরপর তাঁরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ও শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন নিলেন। যেখানে জাতীয় সংগ্রাম চলছে, সেখানে তাঁরা শ্রেণিশত্রু খতম করতে গেলেন। আপনি যখন একটি মানুষকে হত্যা করবেন, তখন তাঁর আত্মীয়স্বজন, পরিবার, প্রতিবেশী সবাই বিরুদ্ধে চলে যাবে। সেটাই হয়েছে। ফলে জনগণ তাঁদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করল এবং ৭১-এর আগস্টে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। নিজের বোকামি ও মূর্খতার কারণেই তাঁদের এই অবস্থা হয়েছে।

প্রথম আলো :

ষাটের দশকে আপনিই লিখেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। সেই প্রত্যাবর্তনটা কেমন ছিল?

বদরুদ্দীন উমর: দেশভাগের আগে এখানে একশ্রেণির মুসলমান নিজেদের আরবি ফারসি সংস্কৃতির ধারক-বাহক ভাবতেন। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর সেই ভাবনার লোক আর দেখা গেল না। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের পর সেই প্রচারণা সমাজে ভিত্তি পেল না। তরুণ প্রজন্ম নিজেদের পরিচয় খুঁজতে লাগল। ধীরে ধীরে বাঙালির মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটল। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন লিখলাম।

প্রথম আলো :

আপনি যে সংস্কৃতির সংকটের কথা লিখেছিলেন পাকিস্তান আমলে, সেই সংকট তো এখনো আছে?

বদরুদ্দীন উমর: সংকট তো আছেই। আবার সেই সংকটকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, তার উদ্দেশ্য হলো লুটপাট করা ও ভারতের তোয়াজ করা। তারা নরেন্দ্র মোদিকে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিমূর্তি হিসেবে দাঁড় করার চেষ্টা করছে। সেখানকার লেখক ইতিহাসবিদেরা কিন্তু তাঁর ও অমিত শাহর কঠোর সমালোচনা করছেন। তাঁরা ভারতের সব মুসলমান নাম মুছে দিচ্ছে। এর জবাবে ইরফান হাবিব বলেছেন, অন্যদের নাম মোছার আগে অমিত শাহর উচিত নিজের নাম থেকে শাহ বাতিল করা। কেননা শাহ শব্দটি এসেছে ইরান থেকে।

প্রথম আলো :

আপনি বহু বছর থেকে সংস্কৃতি পত্রিকা বের করছেন। সমাজে কতটা প্রভাব রাখতে পারছে?

বদরুদ্দীন উমর: সংস্কৃতি পত্রিকা আমি ১৯৭৪ সাল থেকে বের করছি। সমাজে প্রভাব ফেলবে কী, আপনারাই তো পড়েন না। তারপরও সীমিতসংখ্যক মানুষের কাছে পত্রিকাটি পৌঁছেছে। নভেম্বর সংখ্যায় আমি লিখেছি, কংগ্রেস থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি। এর আগের সংখ্যায় ছিল ভারতের ইতিহাসচর্চা নিয়ে। এ দেশের লোকজন তো পড়াশোনা তেমন করেন না। আমার লেখালেখি নিয়ে যা আলোচনা ভারতেই হয়েছে। আমি একটি কথা বলি, এই বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মননশীলতা বলে কিছু নেই। ফাঁপা জিনিস নিয়ে লাফালাফি হচ্ছে। মননশীলতা নেই। সে রকম লেখকও নেই।

প্রথম আলো :

রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা—এর কোনটিকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

বদরুদ্দীন উমর: একসময় আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সংগঠিত করেছি। কিন্তু এই নব্বই বছর বয়সে তো সেটি সম্ভব নয়। এখন তো ঘরের বাইরে যেতে পারি না। এখন লেখালেখিও কম করি। সংস্কৃতি ও কলকাতার দু–একটি পত্রিকায় লিখি। তবে পড়ি বেশি। চারতলায় আমার পাঠাগারটি পড়ার মতো অনেক বই আছে। আবার অনলাইনে কিনেও অনেক বই সংগ্রহ করি।

প্রথম আলো :

তা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মননশীলতা তৈরি হলো না কেন?

বদরুদ্দীন উমর: শরীরে ইনজেকশন দিয়ে তো মননশীলতা তৈরি করা যায় না। রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেও এটি পাওয়া যাবে না। এর জন্য চর্চা দরকার। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই। কিন্তু ভারতে মোদি সরকার যতই দুর্বৃত্তায়ন চালাক না কেন, সেখানে প্রগতিশীলেরা, কমিউনিস্টরা ইতিহাসচর্চা করছেন। রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, অমিয় কুমার বাগচীর মতো অনেক ইতিহাসবিদ আছেন। আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকান, কোনো ইতিহাসবিদ নেই। এমনকি সৃজনশীল সাহিত্যেও তো আখতারুজ্জামান, হাসান আজিজুল হকের পর উল্লেখ করার মতো কাউকে দেখছি না। এই যে সাতচল্লিশ সাল থেকে এত সংগ্রাম করে এখন যে অবস্থা দাঁড়াল, তা খুবই হতাশাজনক। অর্থনীতির দিকে তাকালেও দেখব একদিকে মেট্রোরেল হচ্ছে, টানেল, পাতাল রেল হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই, সেতু নেই। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। ঢাকা থেকে দু-ঘণ্টায় চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু আমাদের দেশ তো জাপান নয়। এই অর্থ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা যেত। স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবস্থা খুবই শোচনীয়। উন্নয়নের সুফল তো ১ বা ২ শতাংশ মানুষের কাছে যাচ্ছে। জিনিসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না ঠিক, তারা অপুষ্টিতে ভুগছে। বৈষম্য সর্বত্র।

প্রথম আলো :

আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে শিক্ষার হাল কী?

বদরুদ্দীন উমর: শিক্ষাব্যবস্থার কথা কী বলব? নতুন প্রজন্মের কেউ তো এখন বাংলা পড়ে না। আমার আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েরাও বাংলা জানে না। ইতিহাস জানে না। বাংলাদেশই এমন একটি দেশ, যেখানে ইতিহাস পাঠ্য থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষার ভিত শক্ত না হলে উচ্চশিক্ষা কী করে হবে? এর অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে মেধাবী ছাত্র নেই। বাইরে যারা চলে যায়, তারা ভালো করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এখানে পারছে না। এখানে চর্চা-গবেষণার সুযোগ নেই।

[ad_2]

Source link

এই বিষয়ের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

এই বিষয়ে সর্বাধিক পঠিত